আমাদের ঘরোয়া নিরাপত্তা এবং…

২০১৩ সালের জুন মাসের পরে কোনো একটা সময়। আমার ক্রীড়া সাংবাদিকতার বয়স তখন ছয় মাসও হয়নি। এর মধ্যেই একদিন যেতে হলো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে। ‘যেতে হলো’ বললাম, কারণ আমি শুরু থেকেই ক্রিকেট নিয়ে কাজ করছিলাম। কোনো একটা অজানা কারণে ফুটবলের প্রতি আমার আকর্ষণটা আর্জেন্টিনা- বিশ্বকাপ বা বার্সেলোনার বাইরে যায় না। মোহামেডান নিয়ে এক সময় তুমুল উত্তেজনা ছিলো অবশ্য। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেটা প্রায় কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরের স্মৃতি।

যা হোক, আমার বাফুফে ‘যেতে হয়েছিলো’ ফুটবলে যিনি কাজ করতেন, আমার কলিগ, তিনি সেদিন উপস্থিত ছিলেন না বলে। খুব সম্ভবত প্রিমিয়ার লিগের ফাইনালের আগের সংবাদ সম্মেলন কাভার করার উদ্দেশ্যেই সে দিন বাফুফে গিয়েছিলাম।

তো সংবাদ সম্মেলনে শুরুতে সালাম মুর্শেদি দুই দলের অধিনায়ক, কোচ এবং উপস্থিত আরো কর্মকর্তাদের সঙ্গে উপস্থিত সাংবাদিকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি তার ঠিক পাশে বসা এক কর্মকর্তার কাঁধে হাত দিয়ে নিজের দিকে টেনে যা বললেন, তা অনেকটা এ রকম, ‘… আর ইনি হচ্ছেন আমার বন্ধু মানুষ… (নামটা মনে করতে পারছি না, দুঃখিত)। উনিও আজ উপস্থিত আছেন।’

প্রথম দিন বাফুফেতে গিয়েই এই সংস্থার অপেশাদারিত্বটা আমাকে দারুণভাবে নাড়া দিলো (নাকি বিরক্ত করলো)। সেদিনই বুঝে গেলাম, বাফুফে আসলে একটা ‘ঘরোয়া প্রতিষ্ঠান’। সেখানে পেশাদারিত্ব একটা ‘কঠিন’ শব্দ।

বাফুফে সম্পর্কিত এই ব্যক্তিগত স্মৃতিটা উল্লেখ করলাম, আমাদের, মানে বাঙালিদের স্বভাবজাত ঘরোয়ভাবটার কথা বোঝানোর জন্য। সৃষ্টিগতভাবেই আমাদের যা স্বভাব, তার সঙ্গে ওই পেশাদারিত্ব ব্যাপারটা যায় না। যায় না তো যায় না, একেবারই যায় না।

এই জায়গাটাতেই আমরা একটা বড় ‘ধরা’ খেয়ে যাচ্ছি। আমাদের ঘরোয়া ফুটবলের কথা বাদ দিলাম। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও কিন্তু পেশাদারিত্ব শুধুমাত্র একটা শব্দ, আদতে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। জাতীয় দল অবশ্য অন্য রকম। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচুর অংশগ্রহণের কারণে, জাতীয় দলের মধ্যে পেশাদারিত্বের অস্তিত্ব বেশ ভালোই।

যা হোক, এবার এই লেখার মূল উদ্দেশ্যের দিকে যাওয়া যাক। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচে এক ‘ভক্ত’ নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেললেন। আগে যা আমরা টিভিতে দেখতাম, কাগজে পড়তাম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে যা আমাদের টাইমলাইনে ঘুরতো, এবার আমরা তা চর্মচক্ষে দেখে ফেললাম; একজন দর্শক খেলা চলা অবস্থায় ঢুকে পড়লেন মাঠে! আমরা চক্ষু ছানাবড়া করে দেখলাম ‘এই রকম কীভাবে হয়’!

এই রকম ঘটনা আমাদের এখানে প্রথম ঘটলো। কিন্তু বিশ্বের কাছে এই ঘটনা এতো আলোচনার বিষয়ই না, যতোটা আমরা করছি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্য নামই তো মাশরাফি বিন মর্তুজা। একজন সাধারণ দর্শকের তো ইচ্ছে করবেই তাকে ছুঁয়ে দেখার। সঙ্গে ছুঁয়ে দেখার একটা সুযোগ যদি ম্যাচ চলা অবস্থায়, হাজার হাজার দর্শক ও অসংখ্য টিভি ক্যামেরার সামনে হয়, তাহলে আরো ভালো! একজন সাধারণ দর্শক এভাবে চিন্তা করতেই পারে।

এখন কথা হলো, ঘটনা যদি ঘটেই যায়, তবে মোকাবেলা কীভাবে করতে হবে? নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত? নিরাপত্তা ব্যবস্থারও তো একটা বৈশ্বিক মানদণ্ড আছে, নাকি? আমরা যেটা দেখলাম, ওই ঘরোয়াভাব। দর্শক মাশরাফিকে ছুঁতে দর্শক মাঠে ঢুকে পড়লো, তাকে ধরে আনতে পিছন পিছন ছুটলো আরো কয়েকজন। সেই কয়েকজনের পোশাকের না আছে কোনো পরিচয়, তাদের শারীরীক ভাষায় না আছে নিরাপত্তকর্মী হওয়ার কোনো চিহ্ন! আমরা এটাও দেখলাম যে, বাংলা ছবির শেষ দৃশ্যের মতো ঘটনার শেষ পর্যায়ে মোটামুটি একটা ভুঁড়ি নিয়ে একজন পুলিশও দৃশ্যমান হলেন। তার সঙ্গে আরো একজন নিরাপত্তরক্ষীকেও দেখা গেলো, যার পোশাক আবার পুলিশের মতো নয়।

শুধু ওই দৃশ্যাটা দেখলেই কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের ভাবনা- চিন্তা সম্পর্কে সবিস্তার ধারণা পাওয়া যায়। মানে, আমাদের কে নিরাপত্তা দিবে, কিভাবে দিবে, তার পোশাক কী থাকবে, সে কিভাবে একজন সন্দেহভাজনকে ধরবে, সন্দেহভাজন একজন হলে তাকে ধরতে কতোজন যাওয়া উচিত; এই সাধারণ প্রশ্নগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর আমাদের কাছে নেই। মাঠের দর্শককে কলারে ধরে মাশরাফি বা সাকিবের সঙ্গে টানাটানি করতে হবে, নাকি কী করতে হবে, সে বিষয়েও আমরা অন্ধকারে।

যা হোক, ঘটনাটা আবার চিন্তা করি। দেখি যে মাশরাফিকে একজন দর্শক জড়িয়ে ধরেছে। তারপর আমরা চিন্তা করি যে, দুজন নিরাপত্তারক্ষী ছুটে মাঠে যাচ্ছেন এবং গিয়ে ওই দর্শককে ‘চ্যাংদোলা’ করে মাঠের বাইরে নিয়ে আসছেন। কী! একটু শান্তি লাগলো তো?

লেখাটা শেষ করি? আমি গত জুন পর্যন্ত একটি জাতীয় দৈনিকে কাজ করেছি। তারপর থেকে নতুন একটি অনলাইন এখন আমার কাজের নতুন জায়গা। তো এই সিরিজের আগে কী হলো, আমি অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড পেলাম না। কেনো পেলাম না; কারণ হিসিবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে আমাকে বলা- এখন নিরাপত্তার যে অবস্থা…!

মানে আমি, একজন ক্রীড়া সাংবাদিক, যে তিন বছর ধরে ক্রিকেট বোর্ডে নিয়মিত যাতায়াত করছে, সেই আমি নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে গেলাম! বিসিবির কী তালগোলে নিরাপত্তা- ভাবনা! এরপর কী হলো, আমি অ্যাক্রিডিটেশন পেলাম। আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ম্যাচটি কাভার করতে গিয়ে দেখলাম, বড়সড় একটা মেশিনে আমার ব্যাগ স্ক্যান করতে হচ্ছে। দেখে ভালোই লাগলো। ভাবলাম এবার অন্তত ওয়াকিটকি-সর্বস্ব কোনো ‘নিরাপত্তারক্ষী’ ব্যাগের দুটো চেইন খুলেই চেক করার দায় সারছে না, যার কাছে কোনো মেটাল ডিটেক্টরও থাকে না। তো মেশিনে চেক-টেক হওয়ার পর আমি ‘নিরাপত্তার জন্য হুমকি নহি’ নিশ্চিত হয়ে প্রেসবক্সে বসে খুশি খুশি লিখতে বসে গেলাম।

তৃতীয় ম্যাচে একটা ঘটনা ঘটলো। ব্যাগ স্ক্যান করার সেই বড়-সড় মেশিনটা নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমাকে আবার ওয়াকিটকি ওয়ালারা চেইন-টেইন খুলে (ব্যাগের) চেক করলো। যাদের কাছে চেক-টেক করার মৌলিক কোনো সরঞ্জামও নেই।

যা হোক, যদি আরো একটা ম্যাচ থাকতো, আমি দেখতাম যে শুধু সাংবাদিক বলার কারণেই আমি ঢুকতে দেয়া হতো। অর্থাৎ যেই আমি সিরিজ শুরুর আগে অদ্ভুত কারণে অ্যাক্রিডিটেশনই পেলাম না, সেই আমি চার নম্বর ম্যাচে গিয়ে খালি সাংবাদিক বলেই চেকড না হয়েই ঢুকে পড়তে পারছি। এই হলো আমাদের সমস্যা- আমরা কোনো কিছুতেই ঘরোয়া ভাব ছাড়তে পারি না। এই কারণেই একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচে আমাদের নিরাপত্তরক্ষীদের বেশভুষার কোনো ঠিক নেই। এই কারণেই আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা গ্যালারির দিকে মনোযোগ না দিয়ে, গ্যালারি পিছনে রেখে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

তো নিরাপত্তা ব্যবস্থা হওয়া দরকার এই রকম- যা পরিস্থিতির কারণে হয়তো বদলাবে, কিন্তু ব্যক্তি বিশেষে পরিবর্তন হবে না। নিরাপত্তা ব্যবস্থা হওয়া দরকার এই রকম- যেখানে কর্মীরা নির্দিষ্ট পোশাক পরা থাকবেন, তাদের বেশভুষা দেখলেই নিজেদের নিরাপদ মনে হবে, তাদেরকে মেনে চলার তাগাদা আসবে মন থেকে। আর যদি আমরা বাফুফেতে ২০১৩ সালে যেমন দেখেছিলাম (এখন কেমন তা আমি জানি না), সেই রকম ঘরোয়াই থেকে যাই, তাহলে নিরাপত্তা বিষয়ে বিশ্বমান বা তার কাছাকাছি আর আমাদের যাওয়া হবে না। ওই ঘরোয়া বাঙালিই হয়ে থাকতে হবে সারা জীবন।

মূল লেখাটা খেলাধুলায় প্রকাশিত

Comments

Post a Comment