যে সব দিনে তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি

যে সব দিনে তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি... Generated by an AI agent.

বহুদিন পর ব্লগের শুন‍্য পাতায় চোখ রেখে খেয়াল করলাম চোখ ভিজে উঠছে! 


কতো কতো দিন চলে গেলো, কিন্তু আমার সেই বিষাদী দিনগুলো থেকে গেলো আমারই বুকজুড়ে— যেনো বিষাদের সাথে আমার অফুরান সখ‍্য। 


এই এতো দিনে কতো কিছু পাল্টে গেলো। বিশ্বজুড়ে শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বড় হচ্ছে, ইউরোপের যুদ্ধের দামামা থেমে থেমে বেজেই চলছে, ফিলিস্তিনে এখনো কেবল রক্ত আর মৃত‍্যু; আর এখানে, আমার দেশেও পটপরিবর্তনের ঝড়ো হাওয়া। 


এই এতো দিনে কতো কিছু পাল্টে গেলো। আমার কণ্ঠ আগের মতো নেই। আমার শরীর আগের মতো নেই। আমার চুলে পাক ধরেছে। বয়সের তুলনায় বেশ ভালোই বুড়িয়ে গেছি! যারা বলে বয়স শুধুই নাম্বার, তারা নিজেরাও কি তা বিশ্বাস করে! নাহ! 


এতো এতো বদলের হাওয়ায় ব‍্যক্তিগত পরিবর্তনের কথা বলতে গেলে হাসি পায়। তারপরও সত‍্য হলো এটাই যে, ব‍্যক্তিগত পরিবর্তনের ঝড়ই আমাকে এখানে নিয়ে আসে, আমি খুলে বসি আমার এই একাকীত্বের ব্লগের ফাকা পাতা। 


০২


তুমি হঠাৎ বলে দিলে আমাদের আর হচ্ছে না। কী হচ্ছে না— দুর্বোধ‍্য তোমাকে না বুঝতে পারা আমি এটাও বুঝতে পারছি না। আমাদের তো হওয়ারই কথা ছিলো না কিছু। তারপরও একটা অপরিকল্পিত যুদ্ধে নেমে গিয়েছিলাম চিরদিনের অপরিপক্ক আমি। 


তুমি প্রতিদিন দেখিয়েছো দুটি ভিন্ন মেরুতে আমাদের অবস্থান। দুটি ভিন্ন জীবন। দুটি ভিন্ন বেড়ে উঠার গল্প। দুটি ভিন্ন পথ ও মতের অনুসারী আমরা। হাত বাড়িয়ে আমাকে তুমি ধরোনি, সত‍্য; কিন্তু এটাও তো সত‍্য যে আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাত তুমি ছুড়ে ফেলোনি। আমার রক্তাক্ত হৃদয়ে বিশ্বাস জন্মানোর জ‍ন‍্য কি আরো কিছু দরকার ছিলো?


এই সব কথা এখানে না লিখে আমি তোমাকেও বলতে পারতাম। কিন্তু তা শোনার মন ও মনন— কোনোটাই তোমার বাকি আছে বলে মনে হলো না। আমি তাই আশ্রয় নিলাম এই বিষণ্ণ কিবোর্ড, আর বিষাদী ব্লগের ফাকা পাতায়।


এটা খুবই বিশ্রী শোনায়, তারপরও এটা সত‍্য যে— আমার আসলে করার কথা ছিলো আরো অনে কিছু, কিন্তু তুমি তুমি করে আমি সে সবের কিছুই করিনি, শুধু একটা একা ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়েছি তোমার অনিচ্ছুক উপকূলে। ফলাফল: কিছুই না! 


তুমি আমি মিলে আমি একজোড়া “আমরা” হতে চেয়েছিলাম। সেটা করতে গিয়ে আমি শুধু তা-ই করতে চেয়েছি, যা “আমাদের” ভালো হয়। কিন্তু তুমি? কেবল ভেবেছো নিজের কথা। একবার, দুইবার, বারবার… না, অভিযোগ না, আমি ইতিহাস বলছি। আমার কিন্তু তাতে আপত্তিও ছিলো না। ওইটুকু স্বাধীনতা সবারই ভোগ করা উচিত। কিন্তু আমারও তো একটা অস্তিত্ব আছে, সেই অস্তিত্বে বাধা আসার আগ পর্যন্ত সবই তো মেনে নিয়েছি।


সব মানতে মানতে একদিন বলে দিলে— আমাদের আর হচ্ছে না! হাহা… 


০৩


কদিন হলো দাদা মৃত‍্যুশয‍্যায়।


আমার জীবনে যাকে খুব বেশি অসুস্থ দেখিনি, জীবনে প্রথমবার যার ব্লাড টেস্ট করার দরকার পড়েছে ১০০ বছর পার হওয়ার পর; সেই লোকটা বিছানায় প্রায় নিথর হয়ে পড়ে আছে। এই দৃশ‍্য দেখার যে কী কষ্ট— তা আসলে আমার পক্ষে বর্ণনা করা কঠিন।


আমার অল্প কিছু শব্দ, আর অল্প একটু ভাষাজ্ঞানে এই যন্ত্রণা বলা অসম্ভব। 


দাদার জীর্ণ মুখে, প্রায় নিস্তেজ হাতে হাত রেখে বুঝতে পারি জীবন কতো ভঙ্গুর, জীবন কতো অনিশ্চিত। হ‍্যা, এ তো যে কোনোভাবেই বোঝা যায়। তারপরও প্রতিবার এই সত‍্য বুঝতে গিয়ে মনে হয় জীবন আসলে প্রত‍্যেকবার আরো একটু বেশি করে অনিশ্চিত হয়ে যায়।


অনিশ্চিত হতে হতে একদিন সব শেষ হয়। আমরা চলে যাই নিশ্চিত এবং অনিশ্বেষ এক গন্তব‍্যে। 


এই চির অনিশ্চয়তার কাছে ব‍্যক্তিগত সম্পর্কের অনিশ্চয়তার কোনো মূল‍্য নেই। 


তোমাকে হারানো বা হারানোর সম্ভাবনা আমাকে আর বিচলিত করছে না। এই ভেবে নিজেকে খুব খারাপ লোক মনে হচ্ছে। 


০৪


একদল আর্মি সুপ্রিম কোর্ট পাহারা দিচ্ছিলো। তাদের একজনের কাছে দৌড়ে এলেন মাঝবয়সী এক নারী। তিন বছর আগে তার ১৬ বছর বয়সী সন্তানকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সেই সন্তানের খোজ তিনি আর পাননি। 


বিলাপ করতে করতে ওই নারী এক আর্মি অফিসারকে কাগজ দেখাচ্ছেন— বোঝাতে চেষ্টা করছেন কিভাবে, কারা তার সন্তানকে কোথায় নিয়ে ফেলেছে… আর্মি অফিসার নির্বিকার। তারও চোখও কি একটু টলমল করে উঠলো? 


অন‍্য একটা লোক ঢাকা মেডিকেলের ফ্লোরে শুয়ে আছে। ত্রিশ পেরোনো বয়স। পাশে বসা তার ছোটো বোন। বোঝা যায় কারও তেমন পুষ্টিকর খাবার মেলে না। ভাই লোকটার চোখ অন্ধ হয়ে যাবে ডাক্তার বলেছে। ছড়ড়া গুলির স্প্লিন্টারের আঘাত কি চোখ সইতে পারে? ভাইটা ফেরি করে সবজি বেচতেন। বোনটা সামলাতেন তার নিজের ঘর। এখন দুজনই হাসপাতালের নোংরা ফ্লোরে ঘোরতর অনিশ্চিত ভবিষ‍্যতের ছক কষছেন। 


তড়ুয়া আরেকটা ছেলের নাম। কী “মেয়ে মানুষী” স্বভাব ছিলো তার। মায়ের সাথে পাটায় মশলা বাটতো সে। লোকে বলতো, ওই তড়ুয়া, তুই মেয়ে নাকি রে! তড়ুয়া হেসে বলতো, আরে, মায়ের সাথে কাজ করতে সমস‍্যা কী? 


তড়ুয়ার এই গল্প বলতে বলতে তার দিদি কাঁদেন। সেই কান্নার ঢেউ আছড়ে পড়ে আমার চোখেও। তারপরও চোখ ও কণ্ঠ শক্ত করে আমি পরের প্রশ্ন করি। তড়ুয়া কী খেতে পছন্দ করতো? তড়ুয়ার পছন্দ ছিলো বোনের বানানো আচাড়। ফ্রিজে এখনো পড়ে আছে আচাড়ের বয়াম। 


কিন্তু কার গুলিতে যেনো হঠাৎ করে মরে যাওয়া তড়ুয়া আর আচার খাবে না। 


০৫


আমি প্রতি রাতে ওই মাকে স্বপ্নে দেখি, যে তিন বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ১৬ বছরের বাচ্চাটাকে খুঁজে পাচ্ছে না।


আমি অন্ধ ওই ভাইটাকে স্বপ্নে দেখি। দেখি তার চারপাশে আরো কয়েক ডজন চোখ ফুলে থাকা, চোখ না থাকা রোগী, তাদের অনেকের গায়ে গুলির চিহ্ন। আমি তড়ুয়াকে স্বপ্ন দেখি। সে তার বোনের বানানো আচাড় আর খাবে না; এই দেশের প্রতি তার এক আকাশ অভিমান। 


স্বপ্নে আমি পাগল হয়ে যাই। এই জুলাই, এই আগস্টে আমি শুধু দুঃস্বপ্নই দেখেছি।


স্বপ্নে আমি তোমাকেও দেখি।


কিভাবে তুমি একটা দুইটা পা ফেলে আমাকে একা রেখে চলে যাও। 


Comments