পথ মসৃণ
ছিলো না মোটেও। তবুও অমসৃণ পথ বেয়ে আমরা ঠিকই চলে এসেছিলাম পরস্পরের বুকের ঘ্রাণে।
পৃথিবীর তাবত সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে আমরা তৈরি করেছিলাম অনিশ্চয়তার নতুনতম
সীমানা। যেখানে পৌঁছানোর ক্ষমতা ও সক্ষমতা অর্জিত হয়েছিলো শুধু আমাদেরই। সেখানে
অনিশ্চয়তার হাত ধরে উল্লাসে মেতে থাকার স্বর্গীয় উদাসীনতা প্রদর্শনীর বিলাস শুধু
আমাদেরই ছিলো।
হয়তো অ্যাঞ্জেলরাও স্রষ্টার সাথে হাসিতে যোগ দিয়েছিলো। স্রষ্টার সভার সে হাসির উপলক্ষ্য ছিলাম আমরা। আমি আর তুমি। পৃথিবীর দুই দূরতম বাসিন্দা, এক হয়ে গিয়েছিলাম কোনো এক অলৌকিক কারণে। সময়ের ভুলে, অসময়ের দ্বিধায়।চমৎকৃত হওয়ার শুরুর সময়টা কেটে যাওয়ার পর তুমি আমি দুই আত্মার এক অস্তিত্ব। আমাদের তখন রাত হতো স্বর্গীয় ঘুমের বার্তা নিয়ে। আমাদের অন্ধকার তখন নিজের মধ্যে ধারণ করতো পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্বাদ। যে স্বাদ আমরা চেখে দেখতাম পরস্পরের অধরে লেগে থাকা মৃদু অন্ধকারে।একটা অসহ্য অতীত ছিলো তোমার। আর আমার ছিলো কাউকে খুঁজে ফেরার উড়ালচণ্ডী মন; হয়তো তোমাকেই। একসময় তোমাকে পেয়েই গেলাম। সময়ের মহাস্রোতে ভাসতে ভাসতে তোমার তীরেই ভিড়ে গেলো আমার তরী। তোমার সমুদ্রজলে প্রথমবার স্নান করা পুরুষ হয়ে গেলাম আমি। অসহ্য অতীতের গল্প শুনতে শুনতে ডুবে গেলাম তোমার অথৈ-গভীরে।আমার কিছুই ছিলো না। তবু কোনো এক অজানা আকর্ষণে তুমি সপে দিয়েছিলে অস্তিত্বের পুরো ভাড়। নিয়েছিলে আমার ভাড়ও। আমার আর তোমার মাঝখানে কোনো বাঁধা ছিলো না, ছিলো না কোনো ফাঁকও।ততোদিনে আমরা ভুলে বসেছি অস্তিত্বের এই ভাড়ের স্মৃতিও একদিন কী ভয়ানক অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে।এতো ভাবনার বয়স তখনো হয়নি। আমারও না। তোমারও না। আমাদের প্রেম-সরোবরে হঠাত করেই জেগে উঠেছিলো চর। কিভাবে তা আমরা বুঝিনি। বুঝেছিলেন স্রষ্টা। আমাদের সাথে স্রষ্টার দূরত্বের দুর্ভাগ্যের কারণে তা আমরা বুঝিনি। স্রষ্টা বুঝেছিলেন। স্রষ্টার তাই মন খারাপ হয়েছিলো হয়তো। সে মন খারাপের কারণ ছিলাম আমি। তুমি। আমরা দু’জন। জন্মের পাপ করে ফেলেছিলাম সেখানেই। তারপরই নেমে এসেছে অনন্ত অন্ধকারের রেখা। যে রেখা ক্রমশ গাঢ় হয়েছে আমাদের দৃষ্টিসীমায়। যে অন্ধকার ক্রমশ দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটি সূক্ষ্ম ভাঁজে। ছড়িয়ে পড়েছে শরীরময়। তারপর আকাশে-বাতাসে, পুরো গ্রহে, গ্রহান্তরে। সৃষ্টিজগত তখন আর সহ্য করবে কেনো আমাদের?
করেনি। আমরা ছিটকে গেছি। পরস্পরের বুক থেকে ছিটকে আমরা সরে গেছি বহু দূরত্বের পথ। যে দূরত্ব অতিক্রম্য নয়। যে দূরত্যের শুরু আছে; শেষ বলে কিছু নেই। শেষটা সৃষ্টি করেননি সৃষ্টিকর্তা। মহান খোদা। তিনি শুধু চেয়েছিলেন আমাদের জীবনের বিচ্ছেদ। যে বিচ্ছেদ সকরুণ গল্প ইতিহাসে দ্বিতীয়টি থাকবে না। যে বিচ্ছেদের দূরত্ব মেপে দেখা যাবে না। যে দূরত্বের লজ্জা পাবে আকাশ ও পাতালের দূরত্বও!বহু দূরের পথ পেরিয়ে আসার পরেও আমার নাকে জীবিত থাকলো তোমার শ্বাস। তোমার শ্বাসের সজীব ঘ্রাণ। মৃত ভালোবাসায় সঞ্জীবনী শক্তি দান করলো সে শ্বাস। সে ঘ্রাণ। অস্তিত্বের ভাড়ের স্মৃতি সত্যিই অসহনীয় যন্ত্রণার হয়ে উঠলো আমার কাছে। পৃথিবীর তাবত সৌন্দর্য আমার কাছে ধরা দিলো নিরুত্তাপ হয়ে। আমার চোখে ফিকে হতে শুরু করলো রঙধনুর রঙিন যৌবন। আমি আবার উড়ালচণ্ডী মনের মালিক। আমি আবার খুঁজি বেড়াই... তোমাকেই!জানি সিগারেট ফুঁকা পোড়া অধরে তোমার অধর আবার একটাবারও ভিড়বে না। আমার আঙুলের ফাঁকে জমে থাকা ছাইয়ে ময়লা হবে না তোমার সোনা আঙুল। তারপরও, আমি তোমাকে খুঁজি। আমার ময়লা টি-শার্টে। আমার ভাঙা খাটে।স্রষ্টার সৃষ্টি মহিমার অপূর্ব প্রকাশ ঘটেছিলো তোমার মধ্যে। সে প্রকাশের সম্পূর্ণ রূপ আমি পেয়েছিলাম বলে তোমাকে ভালোবাসিনি। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ছিলো বিবেকের। যে বিবেকের সৃষ্টি হয়েছিলো এক বৃষ্টির রাতে। মাটির সোঁদা গন্ধে। রঙিন আলোয় তোমার যন্ত্রণাকাতর, একই সাথে সুখে পাগল মুখ দেখেছিলাম আমি।সেই আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনি একটি মহুর্তও। হ্যা, শরীরী তুমি ছিলে না। কিন্তু কল্পণার তুমি একটুও সরতে পারোনি কখনো। এটাই হয়তো তোমার জন্মের পাপ। নিজেকে নিতে পেরেছো অনতিক্রম্য দূরত্বে, কিন্তু রেখে গেছো নিজের অস্তিত্বের অশরীরী ভাগ। আমি নিজে দিনের পর দিন বয়ে চলেছি তা। বয়ে চলেছি।পথটা মসৃণ থাকেনি কেনো জানি না। জানতে পারার ভয়ে এখন দূরে থাকি। কাছে আসার নজীর গড়েছিলাম যেভাবে, তার চেয়েও বহুগুণ বেশি তীব্রতা নিয়ে গড়েছি দূরে সরে যাওয়ার উদহারণ।এখন হঠাত আমার ছায়া, আমার হাঁটা দেখলে, আমায় চিনবে তুমি?
Comments
Post a Comment