মৃত্তিকা পর্ব

আকাশটাই যেনো চাঁদ হয়ে গেছে। কাচের জানলা দিয়ে যতোটুকু আকাশ দেখা যায়, তার পুরোটাই ঝলমল করছে। আজ পূর্ণিমা। চাঁদ তার নিজের আলো বিলিয়ে দিয়েছে আকাশজুড়ে। আকাশ সে আলো ঝরিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীতে। পৃথিবীর পথে আসতে আসতে কিছু আলো মিশে গেছে লোনার জানলায়। কাচের জানলায়। লোনা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।

লোনার এখন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকার বয়স। লোনার এখন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকার সময়। পাশের ঘরে মা। সাথে বাবা। লোনার কানে অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে সুতীব্র কষ্টে কেউ একজন গলা ফাটিয়ে কান্না করতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। মুখে হাত দিয়ে গোঙাচ্ছে তাই। লোনার শ্রবণশক্তি চঞ্চল হয়ে উঠে। স্পষ্ট শব্দ। কেউ তীব্র যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। বোঝা যায় না। শব্দটা ঠিক কোন দিক থেকে আসছে। লোনা চোখ বন্ধ করে। দুহাতে কান চেপে ধরে সে। গোঙানির অস্পষ্ট আওয়াজ ওর সহ্য হয় না। ওই আওয়াজে ওর নিজের মধ্যেও অচেনা কষ্টের তীব্র এক স্রোত বয়ে যায়। স্রোত শুরু হয় বুক থেকে। তারপর রক্তে মিশে যায়। কষ্টের স্রোত রক্তের সাথে মিশে পুরোটা শরীর চক্কর দেয়। প্রচণ্ড কষ্টে লোনা দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরে। কিন্তু শব্দটা পুরোপুরি দূর হয় না। তবে ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসে।

আজ প্রথমবার নয়। এমন গোঙানি মাস খানেক আগেও একবার কানে এসেছিলো। সেদিন এতোটা যন্ত্রণা সৃষ্টি করেনি। কিন্তু আজ অন্য রকম। পূর্ণিমার রাতে লোনার মন খারাপ থাকে। আজও মন খারাপ। আজ একটু বেশি খারাপ। গোঙানির শব্দটাই মনটা একটু বেশি খারাপ করে দিয়েছে। রাত বাড়তে থাকে। সাথে বাড়তে থাকে জোসনার তেজও। অন্য সময় এমন রাতে অন্ধকার গাঢ় হয়। আজ তা না। আজ জোসনার রাত। আজ রাত বাড়লে কেবল তেজ বাড়বে জোসনার। তাই হচ্ছে। সাথে তেজ বাড়ছে যন্ত্রণারও। লোনার মাথাটা ভার হয়ে আসে। গোঙানির উৎসটা খুঁজতে হবে। এখন না। রাত পোহালে। রাত পোহানোর কতো বাকি? লোনা রাতে বিছানায় শোয়ার আগে হাতঘড়ি খুলে রাখে। আজও রেখেছে। না হলে দেখতে পারতো এখন কটা বাজে। জানতে পারতো রাত পোহাবার কতো বাকি। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না লোনার। তারপরও সে উঠে। জানলা দিয়ে আসা জোসনার আলোয় টেবিলের উপর রাখা হাতঘড়িটা স্পষ্ট দেখা যায়। হাতড়িয়ে খুঁজতে হয় না। ঘড়িতে সময় দেড়টা। রাত পোহাবার অনেক বাকি।

লোনা গোঙানির শব্দটা শুনতে চেষ্টা করে। তার আগে বন্ধ করে চোখ। শোনা যায় না। গোঙানিটা আর শোনা যায় না। তবে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে এবার। সাথে দীর্ঘশ্বাসের ভারি আওয়াজ। লোনার মাথা ঘুরে। কী হচ্ছে এসব? ও গোঙানির শব্দের উৎস খুঁজে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে কে জানতে চায় ও, দীর্ঘশ্বাসের উৎসমুখ খুঁজে। এতো রাতে কী করবে লোনা ভেবে পায় না। বিছানা ছেড়ে উঠে আরো একবার। মায়ের দরজায় একটা টোকা দেয়। কোনো সাড়া নেই। আরো একবার টোকা দেয়। কোনো সাড়া নেই। হঠাত কান্নার আওয়াজটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আরো একবার দরজায় টোকা দেয় লোনা। মা কোনো সাড়া দেন না। মা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। তার শরীর ভালো নেই কদিন ধরে। বাবাও ঘুমিয়ে পড়েছেন। সারা দিন খুব পরিশ্রম গেছে তার উপর দিয়ে। দরজায় পড়া টোকার শব্দ তাঁদের কানে যায়নি। তাই সাড়া নেই। তাঁরা ঘুমুচ্ছেন। তাই সাড়া নেই। লোনা ধীরপায়ে হেঁটে ওঠে আসে বিছানায়।

জোসনা রাত। পুরোটা আকাশ যেনো চাঁদ হয়ে গেছে। কাচের জানলা দিয়ে জোসনার আলো লোনার কোলে এসে পড়ছে। তারপরও ভয় করে লোনার। তার ভূতে বিশ্বাস নেই। ভূতেদের নাকি ভয় থাকে না। কষ্টও থাকে না। ভূতেদের তাই গোঙানির কথা না। ফুঁপিয়ে কান্নাটাও ভূতেদের সাথে যায় না। দীর্ঘশ্বাসটাও মানায় না। তারপরও ভূতের ভয় করে। লোনা আস্তে করে চোখ বন্ধ করে। আবারো কোনো শব্দ শোনা যায় কিনা খেয়াল করে। না। আর কোনো শব্দ নেই। লোনা ঘুমানোর চেষ্টা করে। কাচের জানলায় পর্দা টেনে দেয়। গোঙানির শব্দ নেই। কান্নার শব্দ নেই। লোনা ঘুমিয়ে পড়ে। বাইরে বাড়তে থাকে জোসনার তেজ। বাইরে এগিয়ে আসতে থাকে ভোর।

পৃথিবীর কোনো সন্তানই তার মায়ের হাসি অপছন্দ করে না। কিন্তু লোনা করে। মাকে হাসতে দেখলেই লোনা রেগে যায়। মাও তাই ওর সামনে হাসেন না কখনো। একেবারেই যখন না পারেন তখন হাসেন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মায়ের মুখি হাসি দেখে প্রচণ্ড রাগ হয় লোনার। একমাত্র টিভি বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কোথাও মেয়েরা বাসন ধোয়ার সময় হাসে না। কিন্তু লোনার মা হাসেন। তিনি বাসন ধোন আর হাসেন। তিনি জামা কাপড় ধোয়ার সময়ও হাসেন। লোনার প্রচণ্ড রাগ হয়। রাগে চেঁচিয়ে উঠে মাকে হাসতে না করে লোনা। মা হাসা বন্ধ করেন। কখনো বন্ধ করে আবার হাসেন আর আঁড় চোখে মেয়েকে দেখেন। একটাই মেয়ে তার। সুন্দরী। রেগে উঠলে আরো বেশি সুন্দর হয়ে যায়। লোনার মায়ের নাম ফারিহান। ফারিহান আক্তার। ছেলেদের নামের মতো নাম। লোনার নানার ছেলে নেই। ওর মা ছাড়া আর কোনো মেয়েও নেই। লোনার মা’রও তেমন। ছেলে নেই। লোনা ছাড়া কোনো মেয়েও নেই। লোনার নানা তার মেয়ের নাম রেখেছন ফারিহান। কিন্তু ডাকেন ফারিহা বলে।

মেয়ের দিকে না তাকিয়ে হাসেন ফারিহা আর বাসন ধোন। লোনা দেখে ফেলে। রেগে যায়। ফারিহা হাসি থামান। মেয়ের রেগে যাওয়া মুখটা দেখেন। তাঁর মনটা ভালো হয়ে যায়। এই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ফারিহা বাঁচেন। মেয়েকে তিনি নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। সব মেয়েরা মা হলে বদলে যান। ফারিহাও বদলে গেছেন। মেয়ের জন্মের পর মেয়েই তার সব। তাই নিজের চেয়ে বেশি ভালো তিনি মেয়েকে বাসেন। মেয়েও মা বলতে পাগল। ঊনিশ বছর বয়সী মেয়ে তার। এখনো ছোট্ট খুকি। মায়ের বেশি আদরেই মেয়ের বয়স বাড়েনি। এখনো বাচ্চাদের মতো মায়ের সাথে অভিমান করে। সারাদিনে তার তিনটি কাজ। মায়ের সাথে রাগ-অভিমান করা। কলেজে যাওয়া আর রায়হানকে ভালোবাসা। এই তিনটি কাজ ছাড়া লোনা কিছু পারে না। কিছু পারতে চায় না। এজন্য তার কোনো ভাবনাও নেই। ঊনিশ বছর বয়সের মেয়েরা অনেক কিছু পারে। লোনা পারে মাত্র তিনটি জিনিস। এই তিনটি সম্পর্কেই জানেন ফারিহা। মেয়েকে তিনি আরো শিখতে বলেন। জীবনটা বুঝতে বলেন। কিন্তু লোনা জীবন বোঝার দিকে মন দিতে চায় না। শুধু মাকে নিয়ে থাকতে চায়। শুধু রায়হানকে নিয়ে থাকতে চায়। আর তাড়াতাড়ি কলেজটা ছাড়তে চায়।

লোনার নতুন দিনটা প্রত্যেকটা দিনের মতো নয়। একবার রেগে যাওয়ার পর আর ঠাণ্ডা হয়নি মেয়ে। ফারিহা দেখেন। খেয়াল করেন। কিছু বলেন না। গাল ফুলিয়ে থেকেই বেলা দশটা বাজায় লোনা। তারপর বের হয় কলেজে। ফিরবে সন্ধ্যার আগে। ফারিহা হাতের কাজ শেষ করে ঘরে আসেন। বিশ বছর আগে প্রথমবার এই ঘরে ঢুকেন তিনি। সেই থেকে এই ঘরটাই তার পৃথিবী। এক সময় আবৃত্তি করতেন। বিয়ের পরও করেছেন। কিন্তু লোনার জন্মের পর আবৃত্তি ছেড়েছেন। আবৃত্তি ছাড়ার আগে তাকে ছাড়তে হয়েছে ফের সন্তান ধারণের ক্ষমতা। লোনার জন্মের সময় ফারিহার ডিম্বাশয়ে বড় ক্ষতি হয়ে যায়। কেটে ফেলে দেওয়ার পরামর্শ দেন অনেকে। তবে শেষ পর্যন্ত আর কেটে ফেলতে হয়নি। কিন্তু চিরদিনের জন্য সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারান তিনি। তাই একটাই মেয়ে তার। তাকে নিয়েই খুশি তিনি। কিন্তু খুশি নন তার বর। লোনার বাবা আফসার মাকসুদ। স্বামীকে খুশি করার মতো কিছু করতে পারেননি ফারিহা। এক সময় বিয়ে করতে বলতেন। কিন্তু স্বামী শোনেননি। এক সময় তিনি কথা বলা বন্ধ করেছেন। আফসারও বিয়ে করেননি। অখুশি থেকেছেন। প্রকাশ করেননি। দীর্ঘকাল কেটে গেছে এভাবে। দ্বিতীয় জীবনের দ্বিতীয় পর্বে ফারিহা বেঁচে থাকছেন শুধু মেয়ের দিকে তাকিয়ে। আর অপেক্ষা করছেন মৃত্তিকা পর্বের; যেদিন মৃত্তিকা ছাড়া কিছু থাকবে না।

সপ্তাহ দুয়েক ধরে ফারিহা অসুস্থ। দিনভর প্রচণ্ড রকম মাথা ঝিমুনি থাকে। সাথে চোখ ব্যথা। শরীরও ভয়াবহ রকমের দুর্বল। অসুস্থতার কাথা স্বামীকে বলেছেন তিনি। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। নামমাত্র দেখানো হয়েছে। নিয়মিত অষুধ নিচ্ছেন ফারিহা। কিন্তু ফল হচ্ছে না। দিনকে দিন ক্ষয়ে যাচ্ছেন তিনি। নিজের মধ্যে টের পাচ্ছেন। এর মধ্যেও স্বামী ঝামেলা করছেন। হঠাত করে কেমন যেনো হয়ে গেছে লোকটা। ইদানিং নেশা টেশা করছেন বলে মনে হচ্ছে। দুজনের মধ্যে একটা ব্যবধান গড়ে উঠছে দিনদিন। ফারিহা টের পাচ্ছেন। কিন্তু কোনো রকম পাত্তা দেওয়ার কথা চিন্তাও করছেন না। তার বেঁচে থাকা মেয়ের জন্য। স্বামী কী করে না করে তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই ফারিহার। জীবনের একটা পর্যায়ে সব সম্পর্কই অর্থহীন মনে হয়। ফারিহার জীবনের ওই সময়টা বড্ড তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। স্বামীর সাথে তার সম্পর্কের কোনো যথার্থ অর্থ তিনি খুঁজে পান না। কেবল মেয়েটার কথা ভাবেন। এই সম্পর্কটাকে মুছে দিতে পারেন না তিনি। নাড়ি ছেঁড়া ধনের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ হেলা করার ক্ষমতা মানুষের নেই। ফারিহা নিজেকে সম্পূর্ণ মানুষ ভাবেন না। এক সময় সম্পূর্ণ ছিলেন। কিন্তু সময়ের স্রোত তাকে কিছুটা ক্ষয় করে দিয়েছে। সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক মানুষ ফারিহা। মানুষ তো! মানুষ বলেই নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধনকে হেলা করতে পারেন না। পারলে অনেক আগেই মুছে দিতেন। তিনি চোখ নিভিয়ে দিতেন। মৃত্তিকা পর্বে যেতেন। পৃথিবীর মায়া ছাড়তেন।

রাত বাড়লেই হিংস্র হয়ে ওঠেন আফসার। অসুস্থ স্ত্রীর উপর হামলে পড়েন। ফারিহার পৃথিবী আগের মতো নেই। শরীরও আগের মতো নয়। স্বামীকে কাছে টানতে পারেন না তিনি। অসুস্থ শরীরে কাছে টানার পানি নেই। কাছে আনার পথকে পিচ্ছিল করার জল নেই। ফারিহা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যান। তার পুরোটা শরীর বিষাক্ত হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে মেয়ের কথা ভাবেন তিনি। সকালে উঠে, কিংবা রাতেই তার স্বামী ঘুমিয়ে পড়লে তিনি চোখ নিভিয়ে দিবেন; ভাবেন। শেষ পর্যন্ত পারেন না। মেয়ের কথা ভেবেই পারেন না। রাত পোহালেই মেয়ের চোখ দেখেন। মেয়েটা তরতর করে বড় হয়ে যাচ্ছে। শরীর বদলে গেছে। বদলে যাওয়া শরীর বড় হচ্ছে। ফারিহা দেখেন। আর রাতের অসহ্য যন্ত্রণার কথা ভুলে যান। ভুলে গেলে কিছু মনে থাকে না। ইচ্ছে করে ভোলা যায় না। অনিচ্ছায় ভুলেন ফারিহা। তারপর আবার একটা রাত আসে। রাত অন্ধকার হয়। এবং আবারো ফারিহা দিনের কথা ভুলে যান। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করেন। তীব্র যন্ত্রণায় ঘোরের মধ্যে পড়ে যান তিনি। তার সারা শরীরে অসংখ্য নরমুখ দেখতে পান। তাদের ধারালো দাঁত ফারিহার মাংস খাবলে খায়। শরীরটা আবার বিষাক্ত হয়ে উঠে।

আবার রাত পোহালে মেয়ের মুখ দেখে সব ভুলে যান ফারিহা। এভাবেই চলতে থাকে। এভাবে চলার সময় আসবে তা ভাবেননি তিনি। কিন্তু ভাবনার বাইরের সব হওয়াই এখন তার জীবন। এভাবে জীবনের দৈর্ঘ্য আর কতোদিন বাড়বে, তা তিনি জানেন না। তারপরও চান না জীবন শেষ হয়ে যাক। মেয়ের মুখ দেখেই বাঁচতে চান ফারিহা। সারা রাত দাঁতে দাঁত চেপে রেখেই বাঁচতে চান ফারিহা। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা হয়তো ফারিহাকে এভাবে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্তটা ঠিক রাখতে চাইলেন না। তাই দিনে দিনে ফারিহার অসুস্থতা বাড়তে লাগলো কেবল। ঘরের কাজগুলো পর্যন্ত অসম্ভব কঠিন পরিশ্রমের হয়ে গেলো ফারিহার কাছে।

আফসারের হিংস্রতা জেগে উঠেছিলো গত রাতেও। নারীদেহের লোভ সামলাতে পারেননি তিনি। নিজের অসুস্থ স্ত্রীর উপর সামান্য দয়াটুকু করেননি তিনি। অথচ তার প্রতি সুতীব্র বিশ্বাস নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন ফারিহা। ভালোবাসার কথা রাখতে গিয়ে নিজের বাবা মায়ের অবাধ্যও হয়েছিলেন তিনি। বিনিময়ে কোনো ফল চাননি ফারিহা। কেবল ভালোবাসার মানুষের কাছে চেয়েছেন ভালোবাসা। চেয়েছেন সারাটা জীবন ভালোবেসে যাওয়ার নিশ্চয়তা। একেবারে যে পাননি তা নয়। পেয়েছেন তবে আফসার তা দিয়েছেন ফারিহার ভালোবাসার বিনিময়ে। ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা। ঠিক আছে। কিন্তু আফসারের কাছে একটা সময় ভালোবাসার মানে দাঁড়িয়েছে শরীরের চাহিদা মিটানো। প্রাণপণে তা মিটিয়ে গেছেন ফারিহা। কিন্তু যখন তিনি ক্ষয়ে গেছেন, তখন প্রকাশ পেয়েছে আফসারের অন্য চেহারাটাও। এতে ফারিহা আফসারকে কোনো দোষ দেননি। দিতে চাননি। নিজের কপালের লেখা বলে সব মেনে নিয়েছেন। স্বামীকে বলেছেন নতুন বিয়ে করে ঘর করতে। আফসার তা করেননি। কেনো করেননি ফারিহা তা জানেন না।

গত রাতে আফসারের হিংস্রতা জেগে উঠেছিলো। মেয়ে কলেজে যাওয়ার পর হাতের কাজ শেষ করে বিছানায় নিজের ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেন ফারিহা। সারা রাতের যন্ত্রণা আর হাতের কাজের ধকল নিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করেন তিনি। দিন দুপুরে ঘুম আসে না ফারিহার। প্রত্যেকটা দিনই এমন হয়। তারপরও চোখ বন্ধ করে চেষ্টা করে যান তিনি। এতে ক্লান্তি দূর হয় না। উল্টো বেড়ে যায়। জীবনটা ক্রমেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। ফারিহা বুঝতে পারেন। ঘুম ঘুম চোখে লোনার মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠে ফারিহার সামনে। মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে। রায়হান নামের একটা ছেলে লোনাকে পছন্দ করে। ফারিহার খুব ইচ্ছে করে লোনাকে রায়হানের পাশে দেখতে। ফারিহা জানেন না তার এই ইচ্ছে পূরণ হবে কিনা।

আজ কিছুটা দেরিতে বাড়ি ফিরলো লোনা। এসেই মায়ের কাজে হাত লাগায় সে। রান্নার কাজে মাকে সাহায্য করে। লোনার মুখটা সকালের মতো ভারী না। লোনার হাসি হাসি মুখটা বেশ শান্তি দেয় ফারিহাকে। মেয়েকে রায়হানের কথা জিজ্ঞেস করেন ফারিহা। লোনা হাসে। উত্তর দেয় না। ফারিহাও হাসেন। মা মেয়ের এমন হৃদ্যতায় মিশে সন্ধা নামে। সন্ধারও বেশ পর বাড়ি ফিরেন আফসার। লোনার বাবা। ফারিহার রাতের বিষ।

আজও আকাশ ভরা আলো। আজ রাতটাকেও পূ্র্ণিমা বলে মনে হয় লোনার কাছে। ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে। আর পুরো আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে চাঁদ। আকাশটাই যেনো চাঁদ হয়ে যাচ্ছে। রাত বাড়ছে। ঘুম নামছে লোনার দুই চোখজুড়ে। লোনা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে ওর কানে গোঙানির শব্দ আসে আবার। কাঁচা ঘুম গভীর স্বপ্নে তলিয়ে দেয় লোনাকে। ভয়ানক এক স্বপ্ন দেখে ও। মানুষের মতো কিছু একটা, নাক নেই। চোখের জায়গাটা ভরাট। কপালে একটা চোখ শুধু। হাতে বড় নখ। সারা শরীরে তেল চিকচিক করছে। এই জন্তুটা খাবলে ধরেছে লোনার মাকে। ফারিহাকে। লোনা দেখছে মায়ের পেটে হাত দিয়ে মাংস ছিঁড়ে ফেলছে হায়েনাটা। মায়ের কাপড় চুয়ে রক্ত পড়ছে। লাল টকটকে হয়ে যাচ্ছে ঘরের মেঝে। লোনা দেখছে। চিৎকার করতে চাইছে। কিন্তু গলা দিয়ে একটু আওয়াজও বের হচ্ছে না। শুধু কানে আসছে গোঙানির শব্দ। মায়ের গোঙানির আওয়াজ আসছে লোনার কানে। দুহাতে কান চেপে ধরছে লোনা। এতে শব্দটা আরো স্পষ্ট হচ্ছে শুধু। চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেলছে ও। কিন্তু কোনো আওয়াজ হচ্ছে না।

হঠাৎ ঘুম ভাঙে লোনার। বুকটা ধড়ফড় করে ওর। বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে ও। বাইরে আলো ফুটেছে। দরজা খুলে বের হয় লোনা। মায়ের ঘরের দরজা খোলা। মেঝেতে শুয়ে আছে কেউ। মুখটা ঢাকা। ঘরের ভিতর খালা-ফুপুদের ভিড়...

Comments