শাহির নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। এও কি সম্ভব? জীবনের প্রায়
দেড়টা দশক যাকে ছাড়া কাটিয়ে দিতে হয়েছে, যার ফেরার আশা
ভুলেও করতে পারেনি ও, সেই রাখিই এতোদিন পর ওর কাছে আসলো! তাও এমন
বৃষ্টিমুখর রাতে? শাহির চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ নিজেকে মস্তিষ্কশূণ্য লাগে ওর।
তুমুল বৃষ্টির রাত, তার উপর মেঘের কান ফাটানো গর্জন; কোনো শব্দই
শাহিরের কানে ঢুকে না। ও বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে রাখির দিকে তাকিয়ে থাকে। রাখির চোখে
মোটা ফ্রেমের চশমা উঠেছে। চশমা পরা রাখিকে নতুন নতুন লাগে। প্রায় পনের বছর আগে
শেষবার দেখা রাখির সাথে এই রাখিকে মেলানো যায় না। আবার অচেনাও লাগে না। শাহির একটা
ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। রাখিকে যে ঘরের ভিতরে আসতে বলা উচিত, এটিও বেমালুম
ভুলে বসে শাহির। রাখি কথা বলে উঠে, আমি কি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো?
রাখির কথায় সম্বিত ফিরে শাহিরের। ও নিশ্চিত হয়, আসলেই রাখি ওর
সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্ত কোনো অলিক কল্পনা নয়। পরাবাস্তব কোনো ভাবনাও নয়।
শাহির রাখিকে ভিতরে আসতে বলে। রাখি ভেজা কাপড় পরে আছে। রাখিকে পরতে দেওয়ার মতো
কোনো পোশাক নেই শাহিরের কাছে। ও কিছুটা বিব্রত হয়। এমন বৃষ্টির রাতে পাশে বাড়িতে
গিয়ে কোনো পোশাক আনাও সম্ভব না। শাহির শুকনো তোয়ালে ধরিয়ে দেয়। রাখি তোয়ালেটা হাতে
নিয়ে চুল মোছা শুরু করে। শাহির অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাখির দিকে। চুল মুছতে
মুছতে শাহিরের দিকে তাকায় রাখি। শাহির বুঝতে পারে রাখি সরতে বলছে ওকে।
শাহির অন্য ঘরে চলে আসে। দেড় দশকের সুদীর্ঘ পথ স্মৃতিতে অনেক ধুলো
জমিয়ে দিয়েছে। তারপরও শাহির কিভাবে রাখির চোখের ভাষা পড়তে পারলো! সময়ের এই দূরত্ব
কি তবে শাহিরের মন থেকে রাখিকে মুছে দিতে পারেনি? শাহিরের মনে এমন
প্রশ্নের উদ্রেক হয়। ঠিক এই মুহূর্তে শাহিরের মাথায় এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর আসে
না। কিছুক্ষণ পর নাম ধরে ডাক দেয় রাখি। শাহিরের বুকের বাঁ পাশটা ধড়ফড়িয়ে উঠে।
কতোদিন পর নাম ধরে ডাকলো কেউ! শাহির আবার আগের ঘরে যায়। রাখি পোশাক বদলে নিয়েছে।
রাখির সাথে থাকা ব্যাগের দিকে এতক্ষণ চোখ পড়েনি শাহিরের। ওই ব্যাগেই জামা-কাপড়
ছিলো। মুহূর্তটা বড় অচেনা লাগে শাহিরের। রাখির কাছে মুহূর্তটা কেমন লাগে তা বোঝা
যায় না।
বাইরের বৃষ্টি ঝড়ের রূপ নিয়েছে। বিদ্যুৎও নেই। মোম জ্বালিয়ে মুখোমুখি
বসে শাহির ও রাখি। গত দেড় দশকের নির্ঘুম রাতগুলোর হিসেবে নিতে ইচ্ছে করে শাহিরের।
ইচ্ছে করে রাখিকে জড়িয়ে ধরে জমিয়ে রাখা চোখের পানি ঝরিয়ে নিতে। কিন্তু ৩৫ বসন্ত
পেরিয়ে আসা কোনো পুরুষের হয়তো কান্না করা মানায় না। শাহির চুপ করে রাখির মুখের
দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইরে মেঘে মেঘে ঘর্ষণ লেখে বিদ্যুৎ চমকায়। সে আলোয় ঘর আলোকিত
হয়। কিন্তু দুই জোড়া চোখ থেকে তবু অন্ধকার সরে না।
Comments
Post a Comment