চোখ

চশমা ছাড়া পৃথিবীটাকে হাতে আঁকা ছবির মতো মনে হয়। সুন্দর, কিন্তু অস্পষ্ট। জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায় ইমরোজ। খুব সম্ভবত আজ পূর্ণিমা। চাঁদ দেখে ইমরোজ নিশ্চিত হতে পারে না। দেখে বোঝার ক্ষমতা ওর কম। চান্দ্র মাসের হিসেবও জানা নেই। বাবাকে জিজ্ঞেস করতে চায় ও। বাবা ঘুমুচ্ছেন। ওপারেশন কক্ষ থেকে সরিয়ে কেবিনে আনা হয়েছে তাকে। এখনো জ্ঞান ফিরেনি। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে ইমরোজ। গত আটাশ বছরে একটিবারের জন্যও বাবাকে এভাবে দেখেনি ও। বাবা আর ওর মধ্যখানে একটা ব্যবধান ছিলো। এখনো আছে। এই ব্যবধানটা হয়তো আর কোনোদিন ঘুচে যাবে নাইমরোজ নিজে আর সে আশা করে না। ব্যবধান থাকলেও বাবার কাছ থেকে কখনোই দূরে সরে যায়নি ও। চোখের সামনে হয়তো ছিলো না, কিন্তু বাবাকে সব সময় মনের খুব কাছে রেখেছে ইমরোজ। বাবার কাছে থাকতে না পারার পরিস্থিতিটা সৃষ্টি করে দিয়েছিলো ইমরোজের ভাগ্য। বিশেষ কোনো কারণে নয়; কেবল ভাগ্যের লেখন ছিলো বলেই বাবার সান্যিধ্য খুব বেশি পাওয়া হয়নি ওর।

বাবা ঘুমুচ্ছেন। না ঘুমুলে জিজ্ঞেস করা যেতো আজ পূর্ণিমা কিনা। জিজ্ঞেস করলেই বাবা উত্তর দিতেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। জীবনে বেশির ভাগ সময় বাবা ইমরোজের কথার উত্তর দেন না। কোনো এক অজানা কারণে এড়িয়ে যান। কারণটা আসলে একেবারে অজানা নয়। আবার সুস্পষ্টও নয়। বাবা যেভাবে চাইতেন ইমরোজ সেভাবে নিজের জীবনটা গড়তে পারেনি। এ কারণেই ইমরোজের উপর বাবার কপট অনুযোগ। অভিযোগও। ইমরোজ কখনো বাবার অভিযোগ খণ্ডাতে চায়নি। ও আসলে মন থেকে মেনেই নিয়েছিলো। বাবার অভিযোগ সত্য না মিথ্যা, এ নিয়েও ভাবনা ছিলো না ইমরোজের। ভাবনা একেবারে ছিলো না বলা ঠিক না, ছিলো, কিন্তু খুবই কম। ওই কম ভাবনা থেকেই ইমরোজ বুঝেছে, ওর প্রতি বাবার অভিযোগ মিথ্যে নয়। তারপরও ইমরোজ কখনো নিজেকে বদলায়নি। নিজের কাছে হারতে চায়নি ও। ইমরোজের নিজের কাছে জেতার বিপরিতে নিজের কাছে হেরে গেছেন ইমরোজের বাবা। কিন্তু ছেলের ভালো মন্দের চিন্তা তিনি সব সময় করেছেন। বাবার ইচ্ছায়ই দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়েছে ইমরোজ। পাঁচটা বছরকে দীর্ঘ বলা যায় কিনা ইমরোজ তা নিশ্চিত নয়। তারপরও ওর কাছে পাঁচ বছরকে দীর্ঘ বলেই মনে হয়। কারণ এই সময়ের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুজন মানুষকে চিরদিনের জন্য হারিয়েছে ও। মানুষ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইমরোজের বাবার কাছেও। একজন ইমরোজের দাদা অন্যজন বুজি। বুজি মানে দাদী।

অস্পষ্ট চাঁদটার দিকে আবার তাকায় ইমরোজ। চশমা ছাড়া চোখে চাঁদের পাশে অনেক মেঘ দেখা যাচ্ছে। ইমরোজ নিশ্চিত না চাঁদের পাশে আসলেই মেঘ আছে কিনা। চাইলেই চশমাটা চোখে দিয়ে ইমরোজ নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু চশমাটা চোখে দিতে ইচ্ছে করে না ওর। আটাশ বছরের একজন যুবক নিজের সব ইচ্ছেকে এভাবে পাশে ফেলে রাখতে পারে না। কিন্তু ইমরোজ পারে। সময়ের হিসেবে বয়স আটাশ হলেও জীবন তার বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে দুই গুণ বেশি। তিনগুণও হতে পারে। ইমরোজ এক দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্পষ্ট হয়ে ধরা দেওয়া চাঁদটাকে আপন মনে করার মতো বিশেষ কিছু নেই। তারপরও চোখ ফেরায় না ইমরোজ। চাঁদের গা ছুঁয়ে উড়ে যাওয়া মেঘেরা নানা রঙ বয়ে চলে নিজেদের অস্তিত্বে। প্রতিটি রঙই যেনো জীবনের হারিয়ে ফেলা দিনগুলোর প্রতিনিধি। ইমরোজের কাছে তাই মনে হয়। ওর চশমা ছাড়া চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে নানা রঙের অতীত। ইমরোজের কাছে অতীত মানে মেধা ও প্রতিভার অপচয়ের গল্প। ইমরোজের কাছে অতীত মানে বাবাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা, আর বাবাকে দেখানো যে আমি একেবারে অথর্ব নই। অথচ এই চিন্তাটা যে কতো দুর্বল তা বুঝতে না পারা। চাঁদের গা ছুঁয়ে যাওয়া অতীতের রঙ চোখ ভিজিয়ে দেয় ইমরোজের।

আটাশ বসন্ত পেরিয়ে আসা কোনো যুবকের চোখ ভিজে উঠা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। ইমরোজ ভিজে উঠা চোখ থেকে জল গড়াতে দেয় না। চাঁদের মুখ থেকে চোখ ফেরার বাবার মুখে। বাবা ঘুমুচ্ছেন। বাবার জ্ঞান ফিরতে কতক্ষণ লাগবে ও জানে না। বাবা চোখ খুলে তাকাক, একবার নাম ধরে ডেকে জিজ্ঞেস করুক কিছু; জীবনে এই প্রথমবার বাবার সাড়া চাইছে ইমরোজ। জীবনের সব প্রথমগুলোই ইমরোজ খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে। বাবার সাড়া পাওয়ার ইচ্ছেটাও যে এবারই প্রথম ইমরোজের বুঝতে কষ্ট হয় না। বাবার ঘুমিয়ে পড়া চোখ দুটি ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে ইমরোজের। বাবার চোখের নিচে কর্মময় এক সুদীর্ঘ জীবনের ছাপ স্পষ্ট। ক্লান্তির দাগও চোখ এড়ায় না। চশমা ছাড়া চোখে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে ইমরোজ।

ইমরোজের বয়স তখন আট নয় হবে। বাড়ি থেকে ছয় সাত মাইল দূরের স্কুলে পড়তো ও। বাবা সাইকেলে করে নিয়ে যেতেন স্কুলে। আজ এতো বছর পর হঠাত বাবার সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাওয়ার কথা মনে পড়ছে। এমন রাতে এভাবে এতো দিন আগের কথা মনে পড়াটা বিস্ময় জাগায় ইমরোজের মনে। নিজের মন ও এমন রাতের সময় নিয়ে উল্টো পাল্টা ভাবনা ভর করে মনে। ইমরোজ ভাবতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। বাবার চোখে আটকে থাকে ওর চোখ।

এভাবেই কিছু দিন আগে দাদার চোখে আটকে থাকতো বাবার চোখ। হঠাত করেই দাদার শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না। বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছিলেন তিনি। দাদার কষ্টের জীবনটার কথা স্পষ্ট মনে আছে ইমরোজের। প্রবাসে থাকার কারণে দাদার জীবনের শেষ দিনগুলো কাছ থেকে দেখা হয়নি। কিন্তু খারাপ যায়নি নিশ্চিত। কারণ বাবা দাদার যতোটা যত্ন নেওয়া দরকার, ঠিক ততোটাই নিয়েছেন। এ নিয়ে ইমরোজের মনে কোনো রকম দ্বিধা নেই। দাদার শরীরের অবস্থাটা যখন খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তখন বাবা দাদার শয্যাপাশে হাসপাতালে একা বসে থাকতেন। খাওয়া নাওয়া সব ভুলে দাদার বসে থাকতেন। আর নামাজ পড়ে দাদার সুস্থতার জন্য দোয়া করতেন। জীবনে মাত্র একবার বাবার চোখে পানি দেখেছিলো ইমরোজ। ছোট বোনের বিয়ের সময়। ছোট বোনটাই বাবার সবচেয়ে আদরের সন্তান। এটি ইমরোজের ধারণা। যদিও ও জানে না আসলেই সন্তানদের প্রতি বাবার ভালোবাসা কখনো কম বেশি হয় কিনা। ইমরোজ জানে না দাদার অসুস্থতার সময়েও বাবা কেঁদেছিলেন কিনা। বাবার চোখে পানি এসেছিলো কিনা।

দাদার শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে থাকে। একদিন ফজরের আজানের সময় দাদা শেষবারের মতো মুখ তুলে তাকান বাবার দিকে। ইমরোজ দেশে ফিরেছে কিনা জিজ্ঞেস করেন। বাবা জানায় ইমরোজ ফিরেনি। দাদা এক গ্লাস পানি খেতে চায়। তারপর খুব শান্তভাবে কিছুক্ষন বাবার সাথে কথা বলে চোখ বন্ধ করেন। এরপর আর দাদা চোখ খুলেননি। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। দাদার মৃত্যুর মাস চারেক আগে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন বুজিও। চার মাসের ব্যবধানে বাবা ও মায়ের মৃত্যু খুব সহজভাবে নিতে পারেননি বাবা। ক্রমেই অসুস্থ হতে থাকেন তিনিও। এরপরই ইমরোজকে দেশে ফিরতে বলা হয়। তারও আগে জানানো হয় ইমরোজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দুজন মানুষ দাদা ও বুজির মৃত্যুর খবর।

ইমরোজ দেশে ফিরে আসে। এক সপ্তাহের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা। তারপর থেকেই বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে ইমরোজ। শেষ দিকে দাদার চোখ ঠিকমতো কাজ করতো না। দাদার দেখতে কষ্ট হতো। তার আগে বুজিরও একই অবস্থা হয়েছিলো। খুব কাছে না এলে চিনতে পারতেন না কাউকে। ও দুজনের মৃত্যুর অনেক আগে ইমরোজ নানুও চোখ হারিয়েছিলেন। চোখের ভিতরে টিউমার হয়েছিলো তার। পরে সেখান থেকে ক্যান্সার। যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা শরীরে। ফলে ক্যান্সার ধরা পড়ার পনের দিনের মধ্যেই মৃত্যু।

বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে সব কিছু মনে পড়ে যায়। রাত ধীরে ধীরে ভোরের দিকে যাচ্ছে। জানলার বাইরে সুবহে সাদিকের শুভ্র রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চশমা ছাড়াই তা দেখতে পাচ্ছে ইমরোজ। বাবার জ্ঞান এখনো ফিরেনি। ডাক্তারের বেঁধে দেওয়া সময় পেরিয়ে গেছে দুই তিন ঘণ্টা আগে। ইমরোজ ডাক্তারকে ফোন দিতে চায়। কিন্তু দেয় না। বাবা আর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিক। তারপর ডাক্তার ডাকা যাবে। আবার ভয়ও হয় ইমরোজের। বাবা যদি চোখ না খুলে আর! ওর বুকটা ধড়ফড় করে উঠে। চশমা ছাড়া চোখে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে ইমরোজ। জানলার বাইরে স্পষ্ট হতে থাকে সুবহে সাদিকের শুভ্র রেখা। চশমা ছাড়া চোখে বাইরের পৃথিবীটাকে হাতে আঁকা ছবি মনে হয় ইমরোজের কাছে।

Comments

  1. ভালো লাগলো। তবে গল্পে 'ইমরোজ' শব্দটা খুব বেশি বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। পরিবরতে সর্নাবম ব্যবহার করা যেতে পারতো। কিছু বানান ভুল এবং ওয়ার্ড মিসিং আছে।
    আমার কাছে মনে হয়েছে, ইমরোজের ভাবনা আরও একটু স্পষ্ট হলে ভালো হতো।

    সাধারণ বলবো না, তবে যারা ভালো গল্প লিখেন তাদের অনেকের চাইতে অনেক অনেক ভালো হয়েছে। সবকিছুর পর লেখকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এমন গঠনশীল মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

      Delete

Post a Comment