দেশীয় মিডিয়া: নীতিহীনতাই নীতি যেখানে

পান্থপথ, ঢাকা।
একজন লোক পকেট কাটতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। ধরা খাওয়া লোকটিকে আমরা ইচ্ছেমতো মারধর করি। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে নামি দেই। কাজ শেষ। পাবলিক বাসে অহরহ আমরা এমন ঘটনার মুখোমুখি হই।

কিন্তু আসলে কী হওয়া উচিত ছিলো? অপরাধীকে হাতেনাতে ধরে ফেলার পর তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার কথা বলে আইন। আমাদেরও উচিত তাই করা। কিন্তু এই আইনের অনুশীলন কি আমাদের মধ্যে আছে? মোটেও নেই। শহুরে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী থেকে মফস্বলের শিক্ষাবঞ্চিত মানুষদের মধ্যেও একই ধরনের মনোভাব দেখা যায়। শিক্ষা ও অশিক্ষার ব্যবধান ফুটে উঠার কথা আচরণে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাটা প্রকাশ পায় কেবল একাডেমি থেকে পাওয়া সনদপত্রে।

একজন পকেটমারকে ধরে যদি আমরা পুলিশের কাছে দিয়েও দেই, তাহলেই কি সমাধান হয়ে যায়? আইনের পরবর্তী ধাপে কি পকেটমারকে তুলে ধরা হয়? তার বিচার এবং শাস্তি কি আইন অনুযায়ী হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আমাদের যথেষ্ট দ্বিধা আছে। সন্দেহ আছে। এই দ্বিধা এবং সন্দেহ সম্পূর্ণ যৌক্তিকভাবেই আছে।

আইনের কথা বলে বেড়ানো এবং তা সজ্ঞানে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা সাধারণ নাগরিকদের মতো পুলিশদের মধ্যেও বিরাজমান। সাধারণ নাগরিকদের আইনের তোয়াক্কা না করা যতোটা স্বাভাবিক, ঠিক ততোটাই অস্বাভাবিক পুলিশের আইন না মানা। ভয়টা এখানেই। স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে গেলেও আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবান পুলিশবাহিনী তৈরি করতে পারিনি। জাতির একজন এই ব্যর্থতার দায় আমাদের প্রত্যেকের সমানভাবে।

সাধারণ নাগরিক ও পুলিশ হয়ে নীতিহীনতার বিষে নীল হয়ে আছে আমাদের মিডিয়াও। পুলিশের নীতিহীনতার চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার হলো মিডিয়া সংবাদ মাধ্যমের নীতিহীন হয়ে যাওয়া। রাজনীতিবিদ এবং ক্ষমতাবানদের নীতিহীনতা দূর হয়ে যাবে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে, কিন্তু সেই পালাবদল কোনোদিনও হবে না; যদি মিডিয়া নীতিহীন থাকে। এই জায়গায়ই আমরা মনে ধরা খেয়ে গেছি।

মিডিয়া বা সাংবাদিকতার মূলনীতিগুলোর অন্যতম তিনটি হলো সততা, যথার্থতা এবং নিরপেক্ষতা।

এই লেখাটা পড়া বন্ধ করে একটু টিভিতে চোখ বুলিয়ে নিন, অথবা পত্রিকার পাতা উল্টান, অথবা চোখ রাখুন অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোত। কয়েকটি সংবাদ দেখুন বা পড়ুন এরপর যাচাই করুন এই তিনটি মূলনীতির উপস্থিতি কতোটুকু পাচ্ছেন?

আমি বলতে চাই, আমাদের মিডিয়া যে নীতিহীনতা দিয়ে ভরে গেছে তা বুঝতে হলে বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোনো দরকার নেই। দরকার কেবল একটু ভালো করে নির্মোহ হয়ে তাকাতে পারা। এই মুহূর্ত থেকে আত্মসমালোচনার সাহস অর্জন না করতে পারলে আমাদের ভবিষ্যত কোনোভাবেই পরিবর্তন হবে না।

সংবাদ মাধ্যমের নীতিহীনতা দূর করার উপায় আমার জানা নেই। তবে সাদা চোখে যা দেখতে পারি, তা বলে যেতে তো সমস্যা নেই।

আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলোর বেশির ভাগ দখল হয়ে গেছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর টাকার পাহাড়ের কাছে। বেশির ভাগ সংবাদ মাধ্যমের জন্মের ইতিহাস আশাবাদী হওয়ার মতো না। জন্মের উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করেছে অন্য সংবাদ মাধ্যম বা ব্যবসায়ীক গোষ্ঠির বিরোধিতা করার পথ সহজ করা। ফলে উপরের পদগুলোতে নিয়োগ পেয়েছে আজ্ঞাবহ লোকজন। যোগ্যতার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে পদলেহনের সহজাত প্রতিভার বিষয়টি। ফলে স্বাভাবিকভাবে উচ্চপদস্থদের (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সম্পাদক) কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে মালিকের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা। সংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার বিষয় দূরে রেখে সম্পাদকরা খেটে যাচ্ছেন মালিকদের লক্ষ্য পূরণ করতে। অধীনস্থ সংবাদকর্মীরা ভোগ করছেন এর বাজে পরিণতি।

অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের অজুহাত দিয়ে মাসের পর বেতন বাকি রাখার এক অসভ্য সংস্কৃতি দাঁড়িয়েছে আমাদের মিডিয়া পাড়ায়। দিন দিন এই অসভ্যতা এতোটাই প্রকট আকার ধারণ করছে যে, আমার কাছে মিডিয়ার ভবিষ্যত অন্ধকার বলে মনে হয়। না, বেতন না দেয়ার কারণে নয়; নীতিহীন এবং নপুংসক সম্পাদকদের কারণে। যারা সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে কলুষিত করে যাচ্ছেন। সম্পাদকের মতো সম্মানজনক পদটিকে নোংরা করে যাচ্ছেন। এদের কারণে ভবিষ্যতে মেধাবীরা সাংবাদিকতায় আসবে কিনা সন্দেহ।

আরো ভয়ঙ্কর একটি বিষয়ের কথা না বললে এই লেখাটা অস্পূর্ণ থেকে যাবে। নীতিহীনতার বিরুদ্ধে উঠতি সংবাদকর্মীদের মধ্যে কোনো রকম প্রতিবাদ বা প্রতিবাদের ইচ্ছেও দেখা যায় না। এই এরাই ভবিষ্যতে সম্পাদক হবে, তখন পরিস্থিতি আরো কতোটা ভয়াবহ হবে তা অনুমান করা খুব কঠিন নয়। উঠতি সংবাদকর্মীরা আশ্চর্য রকম নীরবতা পালন না করে বেতন না পেয়েও! সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় এরকম অন্যায়ের প্রশ্রয় দেয়া লোকেরা কবে কিভাবে নীতি প্রতিষ্ঠা করবে কে জানে।

আমাদের দেশীয় মিডিয়ার নীতিহীনতার কথা বলতে চেয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। কতোটুকু বলতে পারলাম জানি না। এ বিষয়ে এটিই শেষ লেখা না। আরো বেশ কিছু বলার আছে। সময় করে আবার বসবো।

Comments