আমার প্রথম খুলনা দেখা

পান্থপথ, ঢাকা।
ফেরি থেকে পদ্মা নদী। ছবিটি তুলেছেন দেবাশিষ ফ্লোরিয়া। ক্রিকইনফোর হয়ে খুলনা টেস্ট কাভার করতে আসা ভারতীয় সাংবাদিক।

ডায়েরি লেখার পরিকল্পনাটা পুরোনো। কিন্তু লেখার সময় করতে উঠতে পারছিলাম না। চরিত্রগত অলসতা এবং নানা ব্যস্ততায় বসা হয়নি। একটু দেরিতে হলেও আজ শুরু করলাম। আমি যখন ডায়েরি লিখতে বসেছি, চট্টগ্রামে তখন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ টেস্টে ব্যাটিং করছে বাংলাদেশ। প্রথম সেশনে তামিম-ইমরুল তুলে ফেলেছেন ৯০ রান। অর্থাৎ প্রথম সেশন শেষে ওপেনিং জুটি এখনো অক্ষত।
যা হোক, এই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট কাভার করতেই জীবনে প্রথমবার খুলনা যাওয়া হয়েছিলো আমার। প্রথমবার ফেরিতে উঠার স্মৃতিটাও অর্জন হয়েছে ওই খুলনা যাওয়ার কারণেই। ঢাকা টেস্টে জিম্বাবুয়েকে নাটকীয়ভাবে তিন উইকেটে হারানোর পর খুলনায়ও সদাপট জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ এক ম্যাচ হাতে রেখেই জয় নিশ্চিত করেছেন মুশফিকরা।

খুলনা থেকে ফেরার পথে জয়ের টাটকা স্মৃতি এবং সাকিবের ব্যাট-বলের দুর্দান্ত পারফর্ম দেখার দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা সঙ্গী হয়েছে আমার।

খুলনার উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছিলাম অক্টোবরের ৩১ তারিখ রাতে। গ্রিনলাইনে আমার সহযাত্রী ছিলেন দ্য রিপোর্টের ক্রিকেট প্রতিবেদক রবি ভাই (রবিউল ইসলাম), রাইজিংবিডি-এর ক্রিকেট প্রতিবেদক ইয়াসিন (ইয়াসিন হাসান) এবং ঢাকার টিভি ও পত্রিকার আরো কয়েকজন সহকর্মী ভাই-বন্ধু।

গ্রিনলাইনের আগের জার্নিগুলোর সাথে এবার কিছু একটা মিললো না। খুলনা রুটের গ্রিনলাইনের সিট চট্টগ্রাম রুটের মতো ভালো না বলেই মনে হলো। তারপরও কোনো কষ্ট হয়নি। ঢাকায় সারা বছর ছয় নম্বর তিন নম্বরে ঝুলে অফিস করা আমার জন্য গ্রিনলাইন তো বিরাট ব্যাপার! এ ছাড়া রবি ভাই ও ইয়াসিনদের সাথে থাকায় কিছুটা সংকীর্ণ সিটের বিষয়টা ভুলে গেছি গাড়ি গাবতলি ছাড়ার আগেই।

আমি কখনো ফেরি দেখিনি। আসলে জীবনে খুব বেশিবার ঢাকার বাইরেই যাওয়া হয়নি। ফলে খুলনা যাওয়ার রাতে জীবনে প্রথমবার ফেরি দেখার একটা কৌতুহল ছিলো। গাড়িতে উঠলে ঘড়ির দিকে তাকানোর অভ্যাস নেই আমার। তাই কখন কয়টার সময় আমাদের গাড়ি পাটুরিয়ায় পৌঁছেছিলো এখন মনে নেই। ফেরিতে উঠার আগে দীর্ঘ লাইনের পড়ার অভিজ্ঞতাটা ভয়াবহ।

গাড়ি ফেরিতে উঠার পর কৌতুহল দমানোর সুযোগ এলো। গাড়ি থেকে নেমে ফেরির ফ্লোরে নামলাম। সেখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম উপরে। খুব ধীরে পাটুরিয়া ঘাট দূরে সরে যাচ্ছিলো। আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম স্লো মোশনে। প্রকাণ্ড আকারের ফেরিতে বাস-ট্রাকসহ ছোট বড় ১০-১৫ গাড়ি ছিলো। এতোগুলো গাড়ির ওজন নিয়ে ফেরি কিভাবে এগোয়?

ফেরির দোতলায় দাঁড়িয়ে পাটুরিয়ার দৃষ্টিসীমা থেকে দূরে সরে যাওয়া দেখার পাশাপাশি অন্য আরো একটা বিষয়ে মনোযোগ গেলো আমার। নিঃশ্বাসে নির্মল বাতাস পেয়ে ফুসফুস হঠাৎ যেনো নাচানাচি করে উঠছিলো। এতো বিশুদ্ধ বাতাসে প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার কী যে আনন্দ! এই আনন্দ উপভোগ করতে পারলাম না রাতের না দেখা সৌন্দর্যের খুব কাছে গিয়ে। ফেরির দোতলা থেকে এদিক ওদিক তাকালে শুধু অন্ধকার। অন্ধকারের মধ্যেই কোথাও চোখে পড়ছিলো বাতি।

মনে হচ্ছিলো কোনো বাতি আমাদের দিকে চলে আসছে। কোনো বাতি ধীরে চলে যাচ্ছে আরো দূরে। অন্ধকারের ভিতরে ঢুকে অন্ধকার দেখার মজাটাই আলাদা। এই মজা নিতে নিতেই ওপর গিয়ে পৌঁছালাম। ততক্ষণে রাতের শেষ প্রহর শুরু হচ্ছে।

খুলনা গিয়ে নামতে নামতে সকাল সোয়া আটটা।

শান্ত-সুন্দর শহর। বড় গাড়ি খুব একটা চোখে পড়ছিলো না। অটো এবং রিকশাই বেশি। কোন হোটেলে উঠবো তা আগে থেকে নির্ধারণ করা ছিলো না। খুলনা শহরে শিববাড়ি মোড়ে হোটেল টাইগার গার্ডেনে গেলাম। রুম খালি নেই বলে বেরিয়ে আসতে হলো তখনই। চোখে সারা রাত না ঘুমানোর ক্লান্তি। যা ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে শরীরেও। এর মধ্যে হোটেল না পাওয়া এবং একটু পরই মাঠে গিয়ে বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের অনুশীলন কাভার করার তাড়া; কিছুটা বিরক্তকরই লাগছিলো।

হোটেল সিটি ইনে উঠেছে দুই দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা। সেখানেও রুম না পেয়ে পাশেই একটা হোটেল পেলাম। রুমও আছে। হোটেলের নামটা ইতোমধ্যেই ভুলে গেছি! তবে নামে নর্দান শব্দটা আছে। যা হোক, তড়িঘড়ি করে হোটেলে উঠে ব্যাগ-ট্যাগ রেখে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের উদ্দেশ্যে। এই স্টেডিয়াম আমার চতুর্থ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু।

মাঠের কাজ শেষ করে শেখ আবু নাসেরের প্রেসবক্সে গিয়ে পড়লাম বিপদে। সাথে রবি ভাই আর ইয়াসিন। বিদ্যুৎ নেই। প্রেসবক্সের কাঁচের দেয়াল যেনো পুড়েই যাচ্ছে তাপে। বেশিক্ষণ থাকা গেলো না। কাজ হোটেলে গিয়ে করার উদ্দেশ্যে স্টেডিয়াম ছেড়ে এলাম। হোটেলেও বিদ্যুৎ নেই!

কিছুক্ষণ পর ফোন এলো ঢাকা থেকে। মামুন ভাই (মানবকণ্ঠে আমার সিনিয়র) করেছেন। ঢাকায়ও বিদ্যুৎ নেই। খোঁজ নিতে ফোন দিলাম সাভার। বিদ্যুৎ নেই। সারা দেশেই নাকি বিদ্যুৎ নেই! ঘটনা সত্য। জাতীয় গ্রিডে ভয়াবহ কী এক সমস্যার কারণে সারা দেশেই বিদ্যুৎ নেই। এই নেই নেই বিদ্যুতের মধ্যেই ল্যাপটপের শেষ চার্জ আরো শেষ করে প্রথম দিনের কাজ শেষ করছিলাম। এর মধ্যেই আমাদের হোটেলে এলেন অনীক ভাই (বিডিনিউজের জৈষ্ঠ ক্রিকেট প্রতিবেদক অনীক মিশকাত)। টাইগার গার্ডেনে দুইটা রুম পাওয়া গেছে যেতে হবে এখনই। এদিকে আমরা এই হোটেলে প্রথম দিনের পেমেন্ট দিয়ে ফেলেছি। কী আর করা এই হোটেল ছাড়লাম।

টাইগার গার্ডেনে রুম পেয়েছি বলেই নর্দান হোটেল ছাড়িনি,  ছাড়ার অন্য একটা কারণও ছিলো। এখানে জেনারেটর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। বিদ্যুৎ না থাকায় হোটেল রুমে কোনো আলো-বাতাসও নেই। আসলে হোটেলটা আগে ছিলো বাসা-বাড়ি। পরে হোটেল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিলো। যাই হোক, এই হোটেল ছেড়ে টাইগার গার্ডেনে গিয়ে উঠলাম। সেখানে জেনারেটর চলছে। আমাদের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানও হয়েছে হোটেল পরিবর্তন করে। আগের হোটেলের তুলনায় অনেক ভালো। সন্ধ্যার পর টাইগার গার্ডেনের জেনারেটরও বন্ধ থাকলো প্রায় আধঘণ্টা। ওই আধাঘণ্টা শুরু হওয়ার আগে রুমে মোম পাঠিয়ে দিয়ে রিসিপশন থেকে ফোন করে দুঃখ-টুঃখও প্রকাশ করেছিলো!

পুনশ্চ: লেখাটা শেষ করা হয়নি সময় ও সুযোগের অভাবে। সব মিলিয়ে ভালোই ছিলো প্রথম খুলনা দেখা। বাংলাদেশের জয়ে অনেক স্মরণীয় স্মৃতি নিয়েই ফিরেছিলাম খুলনা থেকে।

Comments