মুস্তফা কামালের পদত্যাগ: বদলে যাচ্ছে ক্রিকেট রাজনীতি

খেলাধুলা কোনোকালেই শুধুমাত্র ‘খেলার’ গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। বিশেষ করে বাজার অর্থনীতির এই যুগে তো নয়-ই। এখন খেলাধুলা মানেই স্পন্সরশিপের মাধ্যমে অর্থের ঝনঝনানি। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা টিভি মিডিয়ার কল্যাণে টিভি-স্বত্ত্ব থেকেও খেলাধুলায় আয় হয় হাজার-কোটি ডলার। ক্রিকেটেও কোনো ব্যতিক্রম নয়। আইপিএল, বিগব্যাশ বা আপাতত বন্ধ থাকা বিপিএলের মতো আসরের কল্যাণে ক্রিকেটও এখন অর্থ উপায়ের দারুণ উপায়। বিশেষ করে ক্রীড়া সংগঠকদের কাছে ক্রিকেট মানে ‘বাণিজ্য-লক্ষ্মী’। খেলাধুলা অর্থবিত্ত কামানোর পাশাপাশি জাতীয়তাবাদ উসকে উঠার উপলক্ষ্যও। খেলাধুলার কারণেই দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে দেশপ্রেম হয়ে গেছে ধর্মের মতো। এখানে ভারত- পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ মানে ভারত- পাকিস্তানের যুদ্ধ। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ- ভারত ম্যাচও একই রকম উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে এবং শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশ- ভারত যুদ্ধের সূচনাটাও। সামনে বাংলাদেশ- ভারত যতো ম্যাচ হবে, তাতে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব থাকবেই। সেই সাথে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক প্রধান এন শ্রিনিবাসনের আইসিসির চেয়ারম্যান হিসিবে বিতর্কিত ভূমিকা এবং তারও আগে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ- ভারত ম্যাচে আম্পায়ারদের দৃষ্টিকটু পক্ষপাতিত্ব।

দেশপ্রেম ও ধর্ম নিয়ে বিস্তর তর্কের সুযোগ আছে। সেই তর্কে যাওয়ার সময় এখন নয়। তারপরও ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক ছিলেন ইয়ন মরগান। তিনি মূলত আইরিশ। তো একজন আইরিশকে কিভাবে ইংলিশ বোর্ড অধিনায়ক বানালো? এমনকি ইংল্যান্ডের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে মরগানের ‘অস্বস্তির’ পরও! এটা তারা করতে পেরেছে, কারণ তাদের কাছে দেশপ্রেমটা ধর্ম নয়।

যা হোক, ক্রিকেট রাজনীতি নিয়ে নতুন করে তৈরি হওয়া ভাবনাগুলো প্রকাশ করা যাক। মুস্তফা কামাল আইসিসি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। আইসিসিতে এই পদটি মূলত অর্থহীন হয়ে যায় ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে তৈরি করা নির্বাহী কমিটির জন্মের পরই। বিগ থ্রি- সম্পর্কিত আলোচনায় অনেক দিন ধরেই সরগরম ছিলো ক্রিকেটাঙ্গন। শুধু কি ক্রিকেটাঙ্গন,আমার তো হয় আমাদের পুরো ক্রীড়াঙ্গনই আসলে উত্তপ্ত হয়ে পড়েছিলো তখন।

ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া মিলে যে দুই স্তরের টেস্ট চালুর চেষ্টা করছিলো তা মাঠেই মারা গেছে। বেশির ভাগ বোর্ড তাতে সম্মতি দেয়নি। কিন্তু আদতে মনে হচ্ছে, বেশিরভাগ বোর্ড সম্মতি দিবে না এটি আইসিসি আগে থেকেই জানতো এবং তাদের দুই স্তরের টেস্ট নিয়ে কোনো ভাবনাও ছিলো না। শুধুমাত্র আরো কিছু করে ফেলার উদ্দেশ্যেই দুই স্তরের টেস্টের নাটক সাজানো হয়েছিলো। যে নাটকে বোকার মতো অভিনয় করেছে গেছে বিগ থ্রি ছাড়া সব বোর্ড। দুই স্তরের টেস্ট নিয়ে যে সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, সে সভায় বিতর্কিত ভূমিকা ছিলো বাংলাদেশের। ঠিক কী ভূমিকা ছিলো তা কখনোই স্পষ্ট হয়নি। হবেও না।

ভারতের বাংলাদেশ সফর, বাংলাদেশের ভারত সফর এবং আরো আরো হাবিজাবি কথা বলে তাৎক্ষণিকভাবে আলোচনার উত্তপ্ত পরিবেশে পানি ঢেলে দেওয়া হয়েছিলো। আসলে বিগ থ্রির যা উদ্দেশ্য, তা ঠিকই পূরণ হয়েছে। যা হোক, সেই আলোচনা অশেষ। সেদিকে না গেলাম। আমরা বরং মুস্তফা কামালের পদত্যাগ এবং তার পর ক্রিকেট রাজনীতি কোন দিকে মোড় নিতে পারে তা নিয়ে একটু ভাবনা চালাই।

ঘটনার সূত্রপাত বাংলাদেশ- ভারত কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। এটি প্রকাশ্য ধারণা। কিন্তু মৌলিকভাবে বাংলাদেশকে খাটো করে রাখা হয়েছে আরো আগে থেকেই। দুই স্তরের টেস্ট চালু না করে এবং বাংলাদেশকে ভারত সফরের ‘প্রলোভন’ দেখানোর সময় থেকেই মূলত আইসিসি (নাকি ভারতের?) বাংলাদেশকে চুপচাপ রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মহাকেলেঙ্কারির কোয়ার্টার ফাইনালে চুপ থাকার মতো পরিস্থিতি আর থাকেনি। কোয়ার্টার ফাইনালের মতো ম্যাচে তিন তিনটি সিদ্ধান্ত ‘ভুল’ করে একটা দলের বিপক্ষে দিলে প্রশ্ন উঠবেই। মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে ভারতের প্রতি আইসিসির ‘আনুষ্ঠানিক’ সমর্থনটি নিয়ে আপাতত কোনো কথা নাই বা বললাম।

ম্যাচের পর আইসিসি প্রেসিডেন্ট আম্পায়ারিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মুস্তফা কামাল আইসিসির প্রেসিডেন্ট হলেও, বাংলাদেশি। সুতরাং বাংলাদেশেরই বিপক্ষে আম্পায়ারদের অবস্থান নিয়ে তিনি নীরব থাকতে পারেন না। কিন্তু আইসিসির তা পছন্দ হয়নি। হওয়ার কারণও ছিলো না। ভারতকে বিশ্বকাপে টিকিয়ে রাখা মানেই আইসিসির বেশি লাভ। তো তুলনায় কম লাভ বাংলাদেশ টিকে থাকলে। আইসিসি তাই ইচ্ছে করে কম লাভের পথে হাঁটতে পারেনি। এ ছাড়া শ্রিনিবাসনরা আরো যে কারণে বাংলাদেশকে নিয়ে ভীত ছিলেন, তা হলো- ভারতের দর্শক। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের কাছে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গিয়ে কী বিপদে পড়েছিলেন তা ভালো বলতে পারবেন রাহুল দ্রাবিড়রা। এবারও যদি বাংলাদেশের কাছে ফিরতে হতো, ধোনিদের দেশে ফেরা প্রায় অসম্ভবই ছিলো। এ কারণেই আর যাই হোক, ‘বাংলাদেশের কাছে ভারতকে হারতে দেওয়া হবে না’ টাইপের প্রতীক্ষা ছিলো আইসিসির। বিষয়টি সুনিশ্চিত নয়; আবার অনিশ্চিতও নয়!

মুস্তফা কামালের পদত্যাগের পর আইসিসির প্রেসিডেন্টের পদে যেতে পারেন পাকিস্তানের নাজাম শেঠি। এ ক্ষেত্রে শেঠিকেও শ্রিনিবাসনের হুকুমের গোলাম হয়ে থাকতে হবে। যদিও যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতায় প্রেসিডেন্টের চেয়ারম্যানের উপরে থাকার কথা। কিন্তু সেই ‘প্রাতিষ্ঠানিকতা’ তো আইসিসি থেকে বহু আগেই বিদায় নিয়েছে।

তো শেঠি যদি শ্রিনিবাসনের বশ্যতা শিকার করেই প্রেসিডেন্ট হন, তবে বেশি দিন তার টেকার কথা না। শ্রিনিবাসন যে ধরনের মানুষ, তাতে একজন পাকিস্তানি খুব বেশি তার হুকুমের গোলাম হয়ে থাকতে পারেন না। সেটি যতোটা না তার নিজের অনিচ্ছায়, তার চেয়ে ঢের বেশি ‘জাতীয়’ চাপে। সব মিলিয়ে আইসিসির প্রেসিডেন্ট পদটা বিলুপ্ত হওয়াটাকে সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। যদি নাও হয়, তারপরও খুব একটা খুশি হওয়ার মতো নিয়ে ক্রিকেট রাজনীতি।

মুস্তফা কামালের পদত্যাগের পর ভারত চাইছে জুনে তাদের বাংলাদেশ সফর বাতিল করতে। ভারতীয় বোর্ডে শ্রিনিবাসনপন্থীরা ইতোমধ্যেই নাকি জরুরি মিটিংয়ের জন্য চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ সফর বাতিলের সিদ্ধান্তের জন্যই তাদের চেষ্টা। অন্যদিকে ভারত বোর্ডে শ্রিনিবাসন বিরোধী জোটও আছে। তারা চাইছে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কটা ধরে রাখতে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে। ভারতীয় বোর্ডে দ্বন্দ্ব মোটামুটি আসন্ন বলেই ধরা যায়।

শেষ পর্যন্ত খুব সম্ভবত বাংলাদেশ সফর বাতিলই করবে ভারত। সে ক্ষেত্রে দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ডের সম্পর্কের সংজ্ঞা বদলে যাবে আমূল। বদলে যাবে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কও। মোদি সরকার বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার পক্ষপাতি। সেটা যেভাবেই হোক। কিন্তু সফর বাতিল হলে সেটা সম্ভব নয়। যদিও কূটনৈতিক মহল তা স্বীকার করবে না। এ ঘটনায় যা হবে, দুই প্রতিবেশি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক খারাপ করে দীর্ঘ মেয়াদী বিপদে পড়ে যাবে ভারত। আপাতত ক্ষমতা প্রদর্শনে এগিয়ে থাকবে তারা। সাময়িক ধসে পড়তে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেট। এমন কি অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস, অন্য দেশে সফর, অন্য দেশের বাংলাদেশ সফর; ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ব্যহত হতে পারে। শ্রিনিবাসনের মতো ‘অগ্রহণযোগ্য’ লোকের কারণেই আশঙ্কাটা এমন।

বাংলাদেশ- পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক খারাপ করে অন্য বোর্ডগুলোর বিশ্বাসও হারাবে ভারত। শ্রিনিবাসনের আইসিসিতে থাকার সূত্রে, আইসিসিও বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। ইংল্যান্ড- অস্ট্রেলিয়া আপাতত এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিবে বলে মনে হয় না। ক্রিকেট রাজনীতিতে তেমন ভূমিকা রাখতে পারবে না নিউজিল্যান্ডও। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকা বা জিম্বাবুয়ে- ওয়েস্ট ইন্ডিজও খুব বেশি উচ্চবাচ্য করবে না। সত্য হলো তাদের সেই শক্তিও নেই। কিন্তু তারপরও এই ইংল্যান্ড- অস্ট্রেলিয়া বাদে অন্য দেশগুলো আইসিসির প্রতি ভরসা হারাবে। বাদ থাকে শ্রীলঙ্কা। লঙ্কানদের সাথে আইসিসির ঝামেলা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বকাপে দলের ব্যর্থতার কারণে সরকার হস্তক্ষেপ করছে লঙ্কান বোর্ডে। যা মেনে নিচ্ছে না আইসিসি। আইসিসি থেকে তাদের নানা হুমকি-ধামকিও দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ লঙ্কানরা আইসিসির কর্মকাণ্ডে আপাতত কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।

সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে, তা হলো আইসিসির সদস্য রাষ্টগুলো ক্রমশ ভারত ও শ্রিনিবাসনদের আজ্ঞাবহ হয় উঠবে অথবা আইসিসি বিভক্ত হয়ে পড়বে অথবা নতুন বৈশ্বিক ক্রিকেট সংস্থার উৎপত্তি ঘটবে। বর্তমান পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ আকার ধারণ করবে বলেই মনে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগবে কিছুটা। ক্রিকেট বোর্ডগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি নিজ নিজ দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও দারুণভাবে প্রভাব ফেলবে এখন থেকে। দেখা যাক আসলে কী হয়! ক্রিকেট রাজনীতির বর্তমান রূপটা বেশ ‘আনপ্রেডিক্টেবল’। ফলে আরো কিছু বিষয় মাথায় থাকলেও আপাতত তা নিয়ে স্পষ্ট বা অস্পষ্ট; কোনো কিছুই বলা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিকে মোটামুটি ‘অশনি সংকেত’ বলে ধরে নেওয়া যায়।

প্রথম প্রকাশ: সামহোয়্যারইন ব্লগ...

Comments