সকাল দেখার শখ

পান্থপথ, ২৮ আগস্ট
ঘটনা আজ সকালের। তখনও মনে হয় সাতটা বাজেনি। আমার হাতে ঘড়ি নেই বলে সময়টা ঠিকঠাক দেখা হয়নি। বাধ্য হয়েই তাই অনুমান করতে হচ্ছে। হঠাৎ রাহাতের ফোন। এতো সকালে ফোন দিয়ে কেউ কখনো আমাকে পেয়েছে কিনা জানি না। কিন্তু রাহাত পেলো। ভাইব্রেটিং মুডে রাখা ফোনটাও জাগিয়ে দিলো আমাকে। ঘুমকাতর গলায় শান্তভাবে হ্যালো বললাম। মনে মনে তখন কোনো বিপদের শঙ্কা। সে রকম কিছু অবশ্য হলো না। সকাল সকাল হঠাৎ সকাল দেখার শখ হয়েছে আমার এই বন্ধুর। উঠে পড়লাম। বহুদিন এতো সকালে বিছানা ছাড়িনি। আজ ছাড়লাম। রাহাতের কারণে বাধ্য হয়ে নয়; আমি কখনো কিছুতে বাধ্য হতে চাই না। সকাল কিভাবে হয়, বহুদিন পর আমারও তা দেখতে ইচ্ছে হলো।

প্রথম গন্তব্য চায়ের দোকান। চা খেতে খেতে টুকটাক গল্প। রাহাতের চোখে- মুখে তখন ঘুমের মতো লেগে আছে সকাল দেখার মুগ্ধতা। এর মধ্যেই দোকানদার অন্তত ১০ বছরের পুরোনো রেডিও সুইচ ঘুরিয়ে 'সেন্টার' ধরানোর চেষ্টা করতে লাগলো। স্মার্টফোন, ট্যাব- ল্যাপটপের রমরমা যুগে ভুলেই গিয়েছিলাম এই প্রচেষ্টার কথা। আজকের সকালটা যেনো আমাদের দুজনকে টাইম মেশিনে চড়িয়ে নিয়ে গেলো দেড় যুগ আগে। যখন মানুষ রেডিও ব্যবহার করতো। রেডিওর যত্নের জন্য চামড়ার কাভার বানাতো! মোটা মোটা ব্যাটারি থাকতো সেই রেডিওর। বাড়ির দুষ্টু ছেলেটা সেই ব্যাটারি ভেঙে কালো কালো কী পদার্থ যেনো বের করে খেলতো। দোকানদারের রেডিওর সেন্টার ঘুরানো আসলে চালু করে দিলো একটা অদৃশ্য টাইম মেশিন।

আমি নিজেকে গত প্রজন্মের শেষ বংশধর মনে করি। যে স্মার্টফোন- ল্যাপটপে ডুবে থাকে। যে ঢাকা ক বা খ'র তিব্বত ঘামাচি পাউডার অনুরোধের আসরের দরাজ গলার উপস্থাপকের কণ্ঠ শুনলেও চমকে যায়; বহুদিন পর চেনা ধ্বনি শোনার আনন্দে ঠোঁট বিস্তৃত করে যে হাসে। আমার মধ্যে দুই দুইটা প্রজন্মের সংস্কৃতি মিলেমিশে এককার। যাত্রাপালার আবছা স্মৃতি যেমন আমার মধ্যে আছে, তেমনি ডিজে পার্টির ইয়ো ইয়ো ডাব্বামার্কা দুই একটা ছেলেমেয়েকেও আমি চিনি। দুই প্রজন্মের প্রতিনিধি হলেও এটা আমি মুখে দাবি করি না। চলনে বলনে প্রমাণ করতে চাই যে, তথাকথিত আধুনিকতার স্রোতে আমার গা ভাসে না। আবার শুধু শুধু বয়স্ক সাজার মতো আতলামিও আমার ধাতে নেই।

চায়ের দোকানদার বেশ সতর্কভাবে সুইচ ঘুরিয়ে চলছে। রেডিওর আওয়াজ স্পষ্ট হলে আস্তে করে সুইচ ছেড়ে দিচ্ছে। সেন্টার পছন্দ না হলে আবার আরো বেশি সতর্কতার সাথে সুইচ ঘুরাচ্ছে। একই সাথে কান খাড়া করে রেডিওর শব্দও শুনছে। কিছুক্ষণ এভাবে গেলো। প্রয়োজনীয় সেন্টারটা সে খুঁজে পেলো কিনা বোঝা গেলো না। কয়েকবারের চেষ্টার পর যে সেন্টারটি সবচেয়ে স্পষ্ট শোনা গেলো, সেখানেই থামলো সে। আমরা চা খেতে খেতে বহু পুরোনো একটা প্রচেষ্টা নতুন করে দেখলাম। এর মধ্যেই মস্তিষ্কে ঘুমিয়ে থাকা দেড়যুগ আগের স্মৃতি জেগে উঠলো। স্মৃতির পরিমাণ সংখ্যায় প্রকাশ করা যায় না। স্মৃতির পরিমাণ আসলে প্রকাশই করা যায় না! নাকি যায়, আমি পারি না?

যাই হোক। অদ্ভুত মুগ্ধতা নিয়ে সেই দিনগুলো স্মরণ করে নানা গল্প জুড়ে দিলাম আমরা। গল্প কতোক্ষণ চললো তা বোঝা গেলো না। আমার মতো রাহাতের হাতেও ঘড়ি নেই। কিছু দিন আগে অবশ্য ওর হাতে চামড়ার ফিতাওয়ালা একটা ঘড়ি দেখেছিলাম। দাম বলেছিলো পাঁচ হাজার টাকা! আমি কখনো অতো দামের ঘড়ি পড়িনি। সে দিন তাই শখ করে সাবধানে ওর ঘড়িটা খুলে হাতে দিয়েছিলাম। পরে ও চলে যাবার সময় ঘড়ি না নিয়েই চলে যাচ্ছিলো। ইচ্ছে করে না। ভুলে গিয়েছিলো। আমিই ডাক দিয়ে অতি সাবধানে ঘড়িটা খুলে ওকে দিয়েছি। না হলে হয়তো ফেলেই চলে যেতো। অতো দামের ঘড়িটা আমার কাছে ফেলে গেলে কী বিপদেই না পড়তাম! আমার চেয়ে বেশি বিপদ অবশ্য রাহাতেরই হতো। এতো টাকার ঘড়ি ফেলে হয়তো কয়েকটা রাত ও ঘুমাতেই পারতো না।

পরে অবশ্য জেনেছিলাম ঘড়িটার দাম পাঁচ হাজার ছিলো না। এমন কি পাঁচশ টাকাও লাগেনি ওটা কিনতে! এরপর আমার আর ওই ঘড়ির দাম নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিলো না। ঘড়িটা রাহাত আজ কেনো পড়ে আসেনি জানি না। হয়তো ফিতাটা ছিঁড়ে গেছে। কিংবা আমার মতো অন্য কোনো বন্ধুকেও পাঁচ হাজার টাকার গল্প শুনিয়েছিলো। এবং আমার মতোই সে বন্ধুটি শখ করে দামি ঘড়ি হাতে দিয়ে দেখতে চেয়ে আর দেয়নি। আমি একবার এ রকম করেছিলাম। তখন আমার বয়স কতো হবে-এই দশ কিংবা বারো। আমার একমাত্র ফুপুর বিয়েতে আব্বা ফুপাকে ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন। তখন নতুন জামাইকে ঘড়ি উপহার দেয়ার রেওয়াজ ছিলো। ঘড়ি না দিলে বরপক্ষ অপমানবোধ করতো। সেই অপমানবোধে বিয়ে ভাঙার খবরও শোনা যেতো মাঝে মাঝে। তো ফুপাকে উপহার দেয়া সেই ঘড়িটা কেনা হয়েছিলো আমার পছন্দে। কী আশ্চর্য! বিয়ের কিছুদিন পর সেই ঘড়িটা হয়ে গেলো আমার। একদিন ফুপা আমাকে আদর করে ঘড়িটা পড়িয়ে দিলেন। সারা বিকেল নতুন ঘড়ি হাতে দিয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরলাম। কারণে অকারণে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সব্বাইকে যথাসম্ভব দেখানোর চেষ্টাও করেছিলাম যে, আমার হাতে একটা ঘড়ি আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমার তৎপরতা বুঝতে না পেরে অনেকে তাকাতো। বেশ ভালো লাগতো তখন। কিন্তু খুব কাছের খেলার সাথীরা তাকাতো না। এতে আমি খুব বিব্রতবোধ করতাম। ওই ঘড়িটা আর ফুপাকে ফেরত দেইনি। বেশ কয়েক বছর ঘড়িটা আমার সব সময়ের সঙ্গী ছিলো।

চা খেয়ে নিরুদ্দেশ হাঁটতে থাকলাম আমরা। বসুন্ধরা সিটির সামনে ততক্ষণে ভিড় জমতে শুরু করেছে। এই ভিড় অবশ্য স্থির না। সচল। পান্থপথের দিক থেকে কিছু লোক যাচ্ছে কাওরান বাজারের দিকে। আবার উল্টো দিক থেকেও আসছে মানুষ। আমাদের মনোযোগ অবশ্য সে দিকে না। সাতসকালে মনোযোগ দেয়ার মতোই কিছু নেই-ই আমাদের সামনে। গত দুই চার দিনের মধ্যে আমার তেমন কিছু লেখা হয়নি। দুই এক লাইন যা-ই লেখেছিলাম। তাই নিয়েই কথা হচ্ছিলো। রাহাতও টুকটাক লেখে। কিন্তু কখনো দেখায় না। কে জানে কেনো দেখায় না! কোনো দিন হয়তো আস্ত একটা বই লেখে আমাকে উৎসর্গ করে চমকে দিবে। সেই চমকে দেয়ার জন্যই হয়তো ও অপেক্ষায় থাকে এবং সে কারণেই হয়তো ও এখন আমাকে কিছুই দেখায় না। আবার এমনও হতে পারে ও কেবল নিজের জন্যই লেখে। তাই অন্য কাউকে দেখাবার প্রয়োজন মনে করে না। আবার এমনও হতে পারে, ও মনে করে ওর লেখা ভালো না; এ জন্য দেখায় না।

বসুন্ধরা সিটির উল্টোপাশের ফার্নিচার মার্কেটের সামনে দিয়ে আমরা পায়চারি করছি। লেখালেখি নিয়ে গল্প করার মতো সময় এখন না। তারপরও আমাদের কথা চলছে। আমরা নিয়ম-না-মানা দুজন সুশৃঙ্খল মানুষ। আমাদের সব কিছুতে অন্যেরা অস্বাভাবিকতা পায়। আমাদের তাতে কিছু যায় আসে না। এভাবেই চলছে। চলে

এর মধ্যে আনুমানিক ঘণ্টাখানেক সময় চলে যাবার পর আমাদের সকাল দেখার ইচ্ছেটা পূরণ হয়ে যায়। আবার ঘুরতে ঘুরতে চায়ের দোকানে ফিরি আমরা। সেই রেডিওতে বাজছে বাংলা গান। চায়ের দোকানে ভিড় জমে গেছে। ঢাকার মানুষ যে পরিমাণ চা খায়, পৃথিবীর অনেক দেশের সব নাগরিক মিলেও হয়তো এতো চা খায় না। হঠাৎ এ বিষয়টা নিয়েই আমাদের হাসাহাসি জমে উঠলো। এবং হাসতে হাসতেই আমরা চায়ের অর্ডার দিলাম! সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বেশ চাঙ্গা লাগছে। সবাই ভাবে, ভালো ভালো খাবার খেলেই মনে হয় মানুষ স্বাস্থ্যবান হয়। চাঙ্গা সময় কাটে। আসলে তা নয়। মাঝে মাঝে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলেও চাঙ্গা ভাব কাজ করে। এই সত্যটা আবিস্কার করার আনন্দ নিয়ে আমরা চায়ে চুমুক দিলাম। তারপর দুজন দুদিকে। রাহাত চলে গেলো নতুন ভাড়া করা বাসায়। আমি পুরো জায়গায়। ততক্ষণে সকাল চলে গেছে। আমার ঘরের কাঁচের জানালা ভেদ করে চলে এসেছে নরম অথচ কড়া রোদ। বহুদিন পর সকাল দেখার শখটা কেমন পূরণ হলো, সেটা ভাবার আর সময় হলো না।

Comments

  1. তুই ভাল লিখিস সেটা জানতাম কিন্তু এতো এতো ভাল লেখিস সেটা জানতাম নারে...

    ReplyDelete
    Replies
    1. সাত সকালে লজ্জায় ফেলে দিলেন ভাই :( আপনি যে এই লেখাটা পড়ছেন, সেটাই আমার স্বার্থকতা।

      Delete
  2. অনেকদিন পর মন দিয়ে অনলাইনে কারো গল্প পড়লাম, বলতে দ্বিধা নেই আমায় সমরেশ আর সুনীল বাবুর প্রাঞ্জলতা যতটা টানে, সেই রকম টানই অনুভব করলাম প্রতিটি লাইনে, শব্দে। অনেকদিন পর আমারো মনে পড়ে গেল নিমাই ভট্টাচার্যের কথা। সেই যে মেমসাহেবের কথা মনখুলে জানিয়েছিলেন সবাইকে-ঠিক তেমনই মন খোলা প্রাঞ্জল তোমার সকাল দর্শন। শুভ কামনা, এগিয়ে যাও...

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভাইয়া, আপনার মন্তব্য পেয়ে সম্মানিত বোধ করছি। আবার আসার আমন্ত্রণ রইলো।

      Delete
  3. তথাকথিত আধুনিকতার স্রোতে আমার গা ভাসে না। আবার শুধু শুধু বয়স্ক সাজার আতলামিও নেই আমার মধ্যে............গল্পের সেরা দুই লাইন......................

    MAMUN HOSSAIN

    ReplyDelete
    Replies
    1. মনের কথাটাই বলতে চেয়েছি। মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ মামুন ভাই।

      Delete

Post a Comment