মাশরাফি বিন মর্তুজার ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান দেখতে গেলে, আপনার আফসোস হবেই। যে তুমুল সম্ভাবনার আলো ছড়িয়ে তার শুরু, পরের পথচলায় তা ছিল না। নাহ, মাশরাফি তার আলো হারিয়ে ফেলেননি কখনোই। বরং দিনে দিনে হয়েছেন পরিণত। ২০০৬ সালে তো সারা পৃথিবীতেই তার চেয়ে বেশি ওয়ানডে উইকেট নিতে পারেননি কেউ! কিন্তু মাশরাফির এমন বিদ্যুৎগতি পছন্দ হয়নি ভাগ্যের। বারবার তাই ইনজুরির কাছে হোঁচট খেয়েছেন তিনি।
মাশরাফির ক্যারিয়ারের দৈর্ঘ্য মাঠে যতটা, তার চেয়ে বেশি বোধহয় মাঠের বাইরে! তারপরও মাশরাফি দমে থাকেননি। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, দেখিয়েছেন নিজের সামর্থ্যরে সীমা। গতকালই যেমন ব্যাট হাতে দানবীয় রূপে আবির্ভূত হলেন ফতুল্লায়। তার ব্যাটিং সক্ষমতার কথা সবাই জানে। কিন্তু গতকাল যে রূপ মাশরাফি ধারণ করলেন, আগে কি কখনো তা দেখা গেছে? ৫০ বলে ১১ ছয়ে সেঞ্চুরি; কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে চারটা হাফ সেঞ্চুরি আগেই ছিল মাশরাফির। তার ব্যাটিং সক্ষমতা তাই নতুন করে বলার মতো কিছু না। মাশরাফির বিঘ্নবহুল ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রায়ই শোনা যায়, ব্যাটিংয়ে আরো একটু মনোযোগ দিলে দারুণ কিছু করে ফেলতে পারতেন তিনি। একের পর এক ইনজুরির আঘাত সইতে না হলে এই আফসোসটাও করতে হতো না। কিন্তু ইনজুরি সেই সুযোগ দেয়নি মাশরাফিকে। দর্শকদের তাই মাঝে মাঝে মাশরাফির ব্যাটিংয়ের ‘ট্রেলার’ দেখেই খুশি থাকতে হয়েছে!
ব্যাটিং-সক্ষমতার ট্রেলারের পর গতকাল ফতুল্লায় মাশরাফি ধরা দিলেন ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য’ রূপে! ঘরোয়া ক্রিকেটের রেকর্ডের পাতায় বইয়ে দিলেন প্রচণ্ড ঝড়। পয়েন্ট তালিকায় নিচের দিক থেকে তিন নম্বরে থাকা দলটি লিগে খুব বড় কিছু করতে পারবে না, এটা প্রায় নিশ্চিত। সেই দলের কাণ্ডারি ও সবচেয়ে বড় তারকা হিসেবে গতকাল শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবকে একাই হারিয়ে দিলেন মাশরাফি। ৫০ বলে সেঞ্চুরি বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান কোনো ধরনের স্বীকৃত ক্রিকেটে এখনো করতে পারেননি। মাশরাফি পারলেন। লিস্ট-এ ক্রিকেটের এক ইনিংসে ১১টি ছয় বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান মারতে পারেননি। সেটাও মাশরাফিই পারলেন। তাতেই নতুন করে লিখতে হলো ইতিহাস।
কিন্তু দুর্ভাগ্য দর্শকদের। ফতুল্লায় উপস্থিত থাকা গুটিকয়েক দর্শক, দুই দলের ক্রিকেটার এবং গণমাধ্যমের কয়েকজন কর্মী ছাড়া মাশরাফির এমন ব্যাটিং-কীর্তি সাক্ষী হওয়া হলো না কারো। আজকাল কোনো খেলা মিস করলে ঘণ্টা কয়েক পরই তা পাওয়া যায় ইউটিউবে, কিন্তু মাশরাফির এই ইনিংসটির তাও পাওয়ার সম্ভাবনা কম। লিগের প্রতিটি ম্যাচেই ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে বটে, কিন্তু বিসিবি কি সেই ক্যামেরার রেকর্ড থেকে মাশরাফির ইনিংসটি প্রকাশ করবে? করলে কিন্তু দারুণ ব্যাপার হবে!
বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে দ্রুততম লিস্ট-এ সেঞ্চুরি করলেও, বাংলাদেশের মাটিতে কিন্তু এর চেয়েও দ্রুতগতির আরো দুটি লিস্ট-এ পর্যায়ের সেঞ্চুরি আছে। ১৯৯৯ সালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ৪৫ বলে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন ব্রায়ান লারা। পরেরটির মালিক জিম্বাবুয়ের ব্রেন্ডন টেলর, ২০১৩ সালে প্রাইম ব্যাংকের হয়ে তিন অংকে পৌঁছতে তিনি খেলেছিলেন ৪৬ বল।
গতকাল মাশরাফি ব্যাটিংয়ে নামেন ৩৬তম ওভারে। ১৬৯ রান করতেই তখন তার দল হারিয়ে বসেছে চার উইকেট। ওই পরিস্থিতিতে দলের রান বাড়ানোর তাগিদ ছিল মাশরাফির। সেটা তিনি করলেন। কিন্তু তিনি যে এতটা নির্মম-নির্দয় হয়ে যাবেন, তা কে ভেবেছিল? ব্যাটিংয়ে নামার পর প্রথম চার বলে মাত্র এক রানে তিনি। কিন্তু নাজমুস সাদাতের পরের দুই বলে নেন দশ রান! মাশরাফির ঝড়ো-তাণ্ডবলীলা শুরু তারপর থেকেই। ৫০ করেন ৩৫ বলে।
এতেই ছয় মারেন চারটি। চার মাত্র একটি। পরের হাফ সেঞ্চুরি করতে মাশরাফি খরচ করেন মাত্র ১৫ বল! ছয় মারেন সাতটি এবং চার মারেন একটি। মাশরাফির এই অবিশ্বাস্য ইনিংসে ভর করে সাত উইকেটে ৩১৬ রান করে কলাবাগান ক্রীড়াচক্র। জবাব দিতে নেমে শেখ জামাল হেরে যায় ২১ রানে। ম্যাচ শেষে মাশরাফি উচ্ছ্বাস করেন দলের জয় নিয়ে। নিজের ইনিংসের চেয়ে দলের জয়টাকেই তিনি দেখেছেন বড় করে। মাশরাফি বলেন, ‘আমরা যদি আরো দুই একটা ম্যাচে ভালো খেলতে পারতাম, তাহলে আমাদের অবস্থান আরো ভালো হতো। সামনে আরো পাঁচটি ম্যাচ আছে, আমাদের ভালো খেলতে হবে।’
মূল লেখা ১৫ মে, ২০১৬-এর মানবকণ্ঠে প্রকাশিত।
মাশরাফির ক্যারিয়ারের দৈর্ঘ্য মাঠে যতটা, তার চেয়ে বেশি বোধহয় মাঠের বাইরে! তারপরও মাশরাফি দমে থাকেননি। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, দেখিয়েছেন নিজের সামর্থ্যরে সীমা। গতকালই যেমন ব্যাট হাতে দানবীয় রূপে আবির্ভূত হলেন ফতুল্লায়। তার ব্যাটিং সক্ষমতার কথা সবাই জানে। কিন্তু গতকাল যে রূপ মাশরাফি ধারণ করলেন, আগে কি কখনো তা দেখা গেছে? ৫০ বলে ১১ ছয়ে সেঞ্চুরি; কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে চারটা হাফ সেঞ্চুরি আগেই ছিল মাশরাফির। তার ব্যাটিং সক্ষমতা তাই নতুন করে বলার মতো কিছু না। মাশরাফির বিঘ্নবহুল ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রায়ই শোনা যায়, ব্যাটিংয়ে আরো একটু মনোযোগ দিলে দারুণ কিছু করে ফেলতে পারতেন তিনি। একের পর এক ইনজুরির আঘাত সইতে না হলে এই আফসোসটাও করতে হতো না। কিন্তু ইনজুরি সেই সুযোগ দেয়নি মাশরাফিকে। দর্শকদের তাই মাঝে মাঝে মাশরাফির ব্যাটিংয়ের ‘ট্রেলার’ দেখেই খুশি থাকতে হয়েছে!
ব্যাটিং-সক্ষমতার ট্রেলারের পর গতকাল ফতুল্লায় মাশরাফি ধরা দিলেন ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য’ রূপে! ঘরোয়া ক্রিকেটের রেকর্ডের পাতায় বইয়ে দিলেন প্রচণ্ড ঝড়। পয়েন্ট তালিকায় নিচের দিক থেকে তিন নম্বরে থাকা দলটি লিগে খুব বড় কিছু করতে পারবে না, এটা প্রায় নিশ্চিত। সেই দলের কাণ্ডারি ও সবচেয়ে বড় তারকা হিসেবে গতকাল শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবকে একাই হারিয়ে দিলেন মাশরাফি। ৫০ বলে সেঞ্চুরি বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান কোনো ধরনের স্বীকৃত ক্রিকেটে এখনো করতে পারেননি। মাশরাফি পারলেন। লিস্ট-এ ক্রিকেটের এক ইনিংসে ১১টি ছয় বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান মারতে পারেননি। সেটাও মাশরাফিই পারলেন। তাতেই নতুন করে লিখতে হলো ইতিহাস।
কিন্তু দুর্ভাগ্য দর্শকদের। ফতুল্লায় উপস্থিত থাকা গুটিকয়েক দর্শক, দুই দলের ক্রিকেটার এবং গণমাধ্যমের কয়েকজন কর্মী ছাড়া মাশরাফির এমন ব্যাটিং-কীর্তি সাক্ষী হওয়া হলো না কারো। আজকাল কোনো খেলা মিস করলে ঘণ্টা কয়েক পরই তা পাওয়া যায় ইউটিউবে, কিন্তু মাশরাফির এই ইনিংসটির তাও পাওয়ার সম্ভাবনা কম। লিগের প্রতিটি ম্যাচেই ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে বটে, কিন্তু বিসিবি কি সেই ক্যামেরার রেকর্ড থেকে মাশরাফির ইনিংসটি প্রকাশ করবে? করলে কিন্তু দারুণ ব্যাপার হবে!
বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে দ্রুততম লিস্ট-এ সেঞ্চুরি করলেও, বাংলাদেশের মাটিতে কিন্তু এর চেয়েও দ্রুতগতির আরো দুটি লিস্ট-এ পর্যায়ের সেঞ্চুরি আছে। ১৯৯৯ সালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ৪৫ বলে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন ব্রায়ান লারা। পরেরটির মালিক জিম্বাবুয়ের ব্রেন্ডন টেলর, ২০১৩ সালে প্রাইম ব্যাংকের হয়ে তিন অংকে পৌঁছতে তিনি খেলেছিলেন ৪৬ বল।
গতকাল মাশরাফি ব্যাটিংয়ে নামেন ৩৬তম ওভারে। ১৬৯ রান করতেই তখন তার দল হারিয়ে বসেছে চার উইকেট। ওই পরিস্থিতিতে দলের রান বাড়ানোর তাগিদ ছিল মাশরাফির। সেটা তিনি করলেন। কিন্তু তিনি যে এতটা নির্মম-নির্দয় হয়ে যাবেন, তা কে ভেবেছিল? ব্যাটিংয়ে নামার পর প্রথম চার বলে মাত্র এক রানে তিনি। কিন্তু নাজমুস সাদাতের পরের দুই বলে নেন দশ রান! মাশরাফির ঝড়ো-তাণ্ডবলীলা শুরু তারপর থেকেই। ৫০ করেন ৩৫ বলে।
এতেই ছয় মারেন চারটি। চার মাত্র একটি। পরের হাফ সেঞ্চুরি করতে মাশরাফি খরচ করেন মাত্র ১৫ বল! ছয় মারেন সাতটি এবং চার মারেন একটি। মাশরাফির এই অবিশ্বাস্য ইনিংসে ভর করে সাত উইকেটে ৩১৬ রান করে কলাবাগান ক্রীড়াচক্র। জবাব দিতে নেমে শেখ জামাল হেরে যায় ২১ রানে। ম্যাচ শেষে মাশরাফি উচ্ছ্বাস করেন দলের জয় নিয়ে। নিজের ইনিংসের চেয়ে দলের জয়টাকেই তিনি দেখেছেন বড় করে। মাশরাফি বলেন, ‘আমরা যদি আরো দুই একটা ম্যাচে ভালো খেলতে পারতাম, তাহলে আমাদের অবস্থান আরো ভালো হতো। সামনে আরো পাঁচটি ম্যাচ আছে, আমাদের ভালো খেলতে হবে।’
মূল লেখা ১৫ মে, ২০১৬-এর মানবকণ্ঠে প্রকাশিত।
Comments
Post a Comment