কেমন সে মানুষ

প্রতি রাতেই সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, সব বাতী যখন নিভে যায়, থেমে যায় যখন সব কোলাহোল, যখন কেউ ওর খোঁজ রাখে না, কেউ শুনে না ওর চাপা কান্নার আওয়াজ, ঠিক তখন হ্যাঁ, ঠিক তখনই ও জানলাটা খুলে দেয়। তারপর গ্রীলের ফাঁক দিয়ে যতোটুকু সম্ভব বাইরে দেখার চেষ্টা করে। রাতের আঁধারে কেউ থাকলেও দেখা যাওয়ার কথা নয়; আর বৃষ্টি যাকে খুঁজে সে তো নেই-ই! সুতরাং খুব স্বাভাবিকভাবেই ও কাউকে খুঁজে পায় না। তবুও ও খুঁজেই চলে। জানলার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে যতোটুকু খোঁজা যায়, ততোটুকুই ও খুঁজে।


খুঁজতে খুঁজতে রাতের আঁধার ওর চোখে ঢুকে পড়ে। ঘুমে বুজে আসে দুই চোখ। ও ঘুমাতে যায়। এবং যাওয়ার আগে জানালাটা বন্ধ করতে একদিনও ভুলে না। গত চারমাস ধরে প্রত্যেকটা রাতেই এরকম হয়।

০২
সে রাতে বৃষ্টি ছিলো। খুব ছিলো বাজ পড়ার বিকট আওয়াজ। আরো ছিলো নিকষ কালো অন্ধকার। সে অন্ধকারে বৃষ্টি দেখেছিলো ওর কাঁচের জানালার পর্দা সরিয়ে। সে রাতেই প্রথমবার ফোন করেছিলো শাহির। বৃষ্টি যাকে ভালোবাসতো এবং ভালো লাগে বলে এখনো যাকে ভালোবেসে যাচ্ছে। ফোন করে শাহিরই প্রথম শুরু করেছিলো একটি স্বপ্নের। নিজে শুরু করার একটা অহংকারও হয়তো ছিলো তার মধ্যে। আর হয়তো সে অহংকারের প্ররোচনায় পড়েই শাহির নিজেই আবার ভেঙে দিয়েছে স্বপ্নটা। শুধু কি ভেঙেই দিয়েছে? ভেঙে গুড়ো গুড়োও কি করেনি? শাহিরের কথা ভাবতে গেলে, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণার কথা মনে পড়লে এবং নিজের চারমাসের অতীতটাকে মনে পড়লে এই প্রশ্ন দুটি বৃষ্টির মনে জাগে। কিন্তু কোনো উত্তরই ও খুঁজে পায় না। যেমন খুঁজে পায় না শাহিরকে।

০৩
কলেজ জীবনের মাত্র তৃতীয় দিনেই শাহিরকে প্রথম দেখেছিলো বৃষ্টি। সেদিনই প্রথম শাহিরের চোখে চোখ পড়েছিলো ওর। প্রথম দিন এর বেশি কিছুই হয়নি। বৃষ্টির ভাবনাতে ভুল করেও এ কথা আসেনি যে, এই শাহিরকেই ও কোনোদিন জীবনের ধ্রুবতারা ভেবে নিবে। প্রথম দিনেই এতোকিছু ভাবার সময় কারইবা হয়...!
একদিন দুইদিন করে প্রথম দিনটা অতীত হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে প্রথম দেখার বয়সটাও। এর মাঝে একটু আধটু কথা বলার, শাহিরের ভেতরটাকে অল্প স্বল্প দেখে নেয়ার সুযোগ বৃষ্টির হয়। এবং তারপর পরই ভাবনার জগতে নতুন কিছুর অস্তিত্ব টের পায় বৃষ্টি। সে ভাবনাতে থাকে শাহিরের প্রতি ওর তীব্র আকর্ষণ। দিনদিন হঠাৎ করেই ভালো লাগা এক মানুষের মাঝে নিজেকে হারাতে থাকে বৃষ্টি।

০৪
গান কবিতার অন্ধভক্ত শাহিরের মনোযোগ বৃষ্টির দিকে যেনো যায়ই না। শাহির সবার সঙ্গে যেমন বৃষ্টির সঙ্গেও তেমন। খুব কথা যেনো তার বলতে মানা! শাহিরের প্রতি ওর অভিমান হয় খুব। শাহির কি একটুও বুঝে না ওকে? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান ধরে চুপ থাকে? কিছুই বুঝে আসে না ওর। বুঝে আসে না- মাঝে মাঝে ওর দিকে শাহিরের তাকিয়ে থাকার মানেটাও। সেই চাহনিতে কি একটু ভালো লাগাও থাকে না? থাকে কি কিছু বলার আকাংখা?

বৃষ্টিমুখর এক রাতে জানালার গ্রীল ধরে নিজেকেই দেখতে দেখতে বৃষ্টি ভাবছিলো এসব। ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠেছিলো।
: হ্যালো… কে?
: আমি শাহির। বৃষ্টি বলছো?

তখন জিহ্বাটা পাথর হয়ে গিয়েছিলো বৃষ্টির। অনেক চেষ্টায় কথা বের হতে চায়নি মুখ দিয়ে। জানালার বাইরের প্রকৃতির তান্ডব যেনো ঝড় তুলেছিলো বৃষ্টির হৃদয়েও। যে ঝড়ে কথারা সব স্থীর হয়ে ছিলো। নড়াচড়াহীন। ওপাশ থেকে শাহির আবার বলে উঠে-
: হ্যালো.. আমি শাহির। বৃষ্টি আছে এখানে?
বৃষ্টির কাছে নিজের অবস্থানটা শূণ্যে মনে হয়। শাহির ফোন দিলো ওকে!
: কোন শাহির আপনি?
: তুমি কয়জন শাহিরকে চিনো?
: আমি তো মাত্র একজন শাহিরকে চিনি।
: ভেবে নাও- আমিই তোমার চেনা শাহির!

কী বলবে বৃষ্টি ভেবে পায় না। এলোমেলো ভাবনাদের নিয়ে ও একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়।
ওপাশ থেকে কথা বলে উঠে-
: হ্যালো… কথা বলো না কেনো? আমি তোমার চেনা শাহিরই!
: আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?
: তুমিই তো দিয়েছিলে…
: আমি দিয়েছিলাম! কবে?
: কাল কলেজে এসো। সব কথা বলবো তোমাকে। এখন শোনো…
: কী…
: বৃষ্টি হচ্ছে ওখানে?
: হ্যা, আপনার ওখানে হয় না?
: হ্যা, আমার এখানেও।

অনেকক্ষণ কথা বলে ওরা।
কথায় কথায় বৃষ্টিকে বৃষ্টি ছোঁয়ায় শাহির। কবিতা শোনায়। গান শোনায়। আর শোনায় ভালো লাগার কথা। ভালোবাসার কথা। এবং শোনায় তিন শব্দের প্রিয় একটা বাক্য। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
পাগলের মতো ভালোবাসি।
শাহির কথাগুলো বৃষ্টির হৃদয়ের ঝড় বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।

০৫
পরের দিন কলেজ পালিয়ে সারাবেলা ঘুরে বেড়ায় ওরা।
বৃষ্টি শুধু চেয়েছিলো আবছা কালো মেঘ। কিন্তু যা পেলো- ঘনকালো মেঘ। মুখরিত বর্ষণ। আর সবশেষে ভেজা একটা স্বর্গ। ঘন মেঘে উড়ে এসে ওকে আপন করে নিয়েছে শাহির। তারপর শাহিরের উষ্ণ আলিঙ্গনে হয়েছে মুখরিত বর্ষণ। যে বর্ষণে সিক্ত হয়েছে দুইটি মন। শাহিরের মনটাকে ও পেয়েছে স্বর্গ হিসেবে। যে রাজ্যের রাণী শুধু ও। সুতরাং নিজের রাজ্যে হাইহিলের ছন্দ তুলে হাঁটতে একটু সময়ও বৃষ্টি নেয় না। তারপর…। দিনে দিনে সপ্তাহ যায়। মাস ফুরায়। গত হয় দুই দুইটি বছরও। ওদের আর আলাদা কোনো ব্যক্তি-অস্তিত্ব থাকে না। দুই দেহে ভাগাভাগি বসত করে একটা মাত্র মন। এই-ই সম্ভবত ভালোবাসা! জীবন-সমুদ্রে শাহিরকেই পথ দেখানো ধ্রুবতারা ভেবে নেয় বৃষ্টি। কল্পনার সবটুকু জুড়ে, ভাবনারা সারাটা জগতে কেবল শাহির এবং শাহির।
সময় বয়ে যায়, যেতেই থাকে।

০৬
তারপর একদিন হঠাৎ করেই রোদ উঠে। সে রোদ সূর্য থেকে বেরোয় না। বেরোয় রুনি নামের এক অষ্টাদশীর রুপ থেকে। সে রোদে শুকিয়ে যেতে থাকে বৃষ্টির ভালোবাসায় সিক্ত শাহিরের হৃদয়। বৃষ্টির স্বর্গরাজ্য। প্রবাসে বড় হওয়া কাজিন রুনির কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয় শাহির। তার ভালোবাসায় ব্যকুল বৃষ্টির কথা সে বেমালুম ভুলে যায়। ভুলে যায় বৃষ্টিকে দেয়া কথা। বৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কটা তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। তুচ্ছ মনে হয় গত দুই বছরের আবেগি দিনগুলোকে। হায়! এভাবেই কি ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়! এভাবেই কি ধ্বসে পড়ে তিল তিল করে গড়ে তোলা বিশ্বাসের প্রাসাদ! এভাবেই কি ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয় স্বপ্ন রাজ্য! রুনির কাছে নিজেকে দিয়ে দিলেও বৃষ্টিকে না করে না শাহির। শাহিরের মতো মানুষ ভালোবাসাযর কাপুরুষ। আর কাপুরুষরা বরাবরই হীন হয়। দূর্বল হয়। প্রতারক হয়। এবং অবশ্যই ভীতু হয়।

শাহিরও একই রকমভাবে হীন, দূর্বল, প্রতারক এবং ভীতু। আর ভীতু বলেই সে বৃষ্টির সামনে আসতে পারে না। বলতে পারে না তার নিজের কথা, তার প্রতি রুনির এবং রুনির প্রতি তার অতীব আকর্ষণের কথা। অবশ্য শাহিরের কথায় কিছু খোঁড়া অজুহাত ছাড়া আছেই বা কী! তাই হয়তো সে ইচ্ছা করেই বলে না কিছু। নিজের কাছেই নিজেকে খুব বেশি অসহায় মনে হয় বৃষ্টির। চুরি যাওয়া ধ্রবতারাকে পেতে চায় সে। নানাভাবে সে ধ্রুবতারাকে ডাকে। নিজের আকুলতা জানায়। কিন্তু ধ্রুবতারা কিছুই শুনে না। সে কেবল দূরেই যায়… এক আকাশ, দুই আকাশ, তিন আকাশ… এভাবে হাজারটা আকাশ কিংবা কোটি আকাশ দূরে চলে যায়। তারপরও জ্বালিয়ে রাখে আশার মৃদু একটু আলো। অনেক দূর থেকে সে কেবল বলে-
: বৃষ্টি, জানলাটা খুলে রেখো। আমি রাতে আসবো। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে…

০৭
শাহিরের বলা কথাটা অর্ধরাত পর্যন্ত বৃষ্টিকে জাগিয়ে রাখে। বৃষ্টিকে দিয়ে খুলিয়ে রাখে ওর জানলাটা। কিন্তু ধ্রুবতারার দেখা মেলে না। শাহিরকে কি এখনো ধ্রুবতারা বলা যায়? নাকি- ভালো হয় ভন্ড-প্রতারক বলাটা? ভালোবাসা হয়তো এমনই- একটু একটু করে শুরু হয়। তারপর মন ও মগজ জুড়ে কিছু দিন দাপুটে বসত। এবং হঠাৎ করেই শেষ। আসলেই কি ভালোবাসা এমন? নাকি- এটা ভালোবাসাই না?

মূল লেখাটা বন্ধুসভায়

Comments