সকালের নরম রোদ ছেলেটার চোখের পাতায় টোকা দেয়। ছেলেটা চোখ মেলে তাকায়। নারকেল ডালের ফাঁক ফোকর দিয়ে চলে আসা রোদের আলো দারুণ এক আল্পণা এঁকে দিয়েছে মুখে। তার ভালো লেগে যায় সকালটাকে। ভালো লাগা সকালেও বুকের ভিতরে এক অস্থীর বিষন্নতা কাজ করে। ছেলেটা হাত মুখ না ধুয়েই বাইরে বের হয়। বাইরে মানে বাড়ীর বাইরে। চারতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে বাইরে যেতে খুব একটা সময় লাগে না তার।
দোকানপাট খুলেনি তখনো। ফোনে টাকা লোড দেয়ার জন্য ছেলেটার অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। সে ধীর পায়ে আবার চলে আসে চার তলায় তার নিজের ঘরে। ইদানিং প্রায় সব কাজেই শেষ পর্যন্ত তার কিছু করার থাকে না। খুব গভীর ও গভীতর বিষাদ তাকে ঘিরে রাখে।
সকাল গড়িয়ে শেষ দুপুরেও ছেলেটার আর বাইরে যাওয়া হয় না। ঘরের ভিতর আর বাহির তার কাছে বেশ দূরত্বের পথ হয়ে উঠে। তবে সে দূরত্ব খুব একটা বাড়তে পারে না। বিকেল যখন তার সর্বশেষ লেজটুকু নিয়ে দিনের সঙ্গে ঝুলে আছে, ঠিক তখন ছেলেটা বাইরে যায়। ছেঁড়া ফাটা এবং স্মৃতিমাখা মানিব্যাগের শেষ একশ টাকার নোটটা ভাঙাতে তার মন নড়ে উঠে। সেই সঙ্গে আরও নড়ে উঠে দুদিন পরেই চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাওয়ার শংকা।
রাতের খাবারে ডাল না থাকলে বড় অভিমান হয় ছেলেটার। হয় না বলে হতো বলা উচিৎ। কারণ এখন তো কোনো দিন পুরো ডাল না খেয়েই কাটাতে হয় তার। আজ হঠাৎ তবু বাড়ীতে রোজ রাতে ডাল খাওয়ার পুরোনো অভ্যেসটার কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেটার শুষ্ক ঠোটে অকৃত্রিম একটা হাসি খেলে যায়। সে হাসিতে খুব অবধারিতভাবে বিষাদের নীল ছায়া পড়েই থাকে। আজ রাতে তাকে খেতে হচ্ছে পেপের এক বিদঘুটে ভাজি। বুয়া এই রান্নাটা কার কাছ থেকে শিখেছে, ভেবে ভেবে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে উঠে তার। মন খারাপ হলেও অদ্ভুদভাবে ছেলেটা তা প্রকাশ করে না। সে নিজে মনে করে এটা তার খুব বড় একটা শক্তি হয়ে উঠেছে। অথচ আগে তো খুব সামান্য মন খারাপেও কেঁদে ফেলতো সে। নতুন অর্জিত শক্তিটা তাই তার খুবই ভালো লাগে।
পড়ালেখা বেশ জমে গেছে। বাধ্য হয়েই আজকাল ছেলেটার পড়তে হয়। এক সময় সে খুব পরিশ্রমী ছাত্র ছিলো। অথচ সেটা এখন সে মনেই করতে চায় না। তবুও কখনো মনে হয়ে গেলে সে এখনকার নিজের সঙ্গে আগের নিজেকে একটুও মেলাতে পারে না। আর এই মেলাতে না পারাটাই সাম্প্রতিক সময়ে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সংকট।
বই নিয়ে বসতে না বসতেই বিদ্যুৎ চলে যায়। শীথানেই বই রেখে দেয় সে। তারপর এক সপ্তাহ ধরে বিছিয়ে রাখা বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে সে ভাবে আগামীকাল বিছানা উঠিয়ে ঘরটা একবার ঝাড়ু দিতে হবে। দুই বছর ধরে মারাত্মক রকম ইনসমনিয়ায় ভোগা ছেলেটার ঘুম আসে না। আসার কথাও না। বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়া যে তার জীবন থেকে উধাও হয়ে গেছে আড়াই বছর আগে। ফেলে আসা গত আড়াইটা বছরই জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়ে গেছে। ছেলেটা তাই মনে করে। রাতের শুরুর ভাগে জানলা দিয়ে এসে পরা ঠান্ডা বাতাসকে ছেলেটার কাছে স্রষ্টার বিশেষ দয়া মনে হয়। সেটা আরো বেশি উপলব্ধি করা যায় যখন বাতাসটা এসে পরে ভ্যাপসা গরমে ভরা ঘরটাতে। ছেলেটার ভাবতে ইচ্ছে করে হঠাৎ আসা এই বাতাসে প্রিয় কারো গায়ের ঘ্রাণ আছে কি না। ইচ্ছেটাকে সে যত্ন করে এড়িয়ে যায়।
এড়িয়ে যেতে পারাটাকেও আজকাল সে নিজের অর্জিত বিশেষ ক্ষমতা বলে মনে করে। যে ক্ষমতার সবিশেষ ব্যবহারে সে এড়িয়ে যেতে পারে জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়াকেও। যেমন এই মুহুর্তে সে এড়িয়ে যাচ্ছে তার স্ত্রীকে, ফোন করার ইচ্ছেটাকে। তবে এটাই তার জীবনের সব চেয়ে বড় চাওয়া কি না, সে বিষয়ে ছেলেটা সন্দিহান। কথা ছিলো তার স্ত্রী তার সঙ্গে থাকবে। কেনো থাকছে না, তা একটা বিস্ময়। বিস্ময় না বলে মহাবিস্ময় বলা উচিৎ। কারণ তাদের বিয়েটা প্রেমের। প্রেমের বিয়েতে কেবল একসঙ্গে থাকাটাই বড় লক্ষ্য হয়।
ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে রাতের অন্ধকার। আর ছেলেটা মোহিত হতে থাকে অন্ধকারের নোনা গন্ধে। শুনতে থাকে অন্ধকারের তরল সূর।
প্রতিটি রাতেই এমন হয়। রাত যতো বাড়ে ছেলেটার মনোজাগতিক ভাবনাও ততোই অলৌকিক ও অস্বাভাবিক হতে থাকে। যদিও সে মনে করে তার সব স্বাভাবিক। হতেও পারে অন্যদের কাছে তা স্বাভাবিক নয়। আর একজনের স্বাভাবিকতা যে অন্যদের কাছেও তার মতোই হবে, এমন তো নয়। গাঢ় থেকে গাঢ়তর অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে ছেলেটা মাতাল হতে থাকে নোনা গন্ধে আর তরল সূরে।
প্রচন্ড অভিমান করে চলে যাওয়া স্ত্রী ঘুমের ঘোরে ছেলেটার কাছে চলে আসে। ফর্সা লম্বা আঙুল চালিয়ে দেয় ছেলেটার চুলে। একেবারে অজান্তে তার মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে সুখের শব্দ। ঘুমের মধ্যে আরো বেশি করে ঘুমায় সে। ঘুমের গভীরতা বাড়তে থাকে। বাড়তেই থাকে। ছেলেটা বেমালুম ভুলে যায় শেষ কবে এতো এতো ঘুমে রাত কাটিয়েছে সে। ঘুমের অনন্ত অতল ছোঁয়ার দূর্নিবার নেশা যেনো তাকে জড়িয়ে ফেলেছে। বহু দিন পর প্রিয় চোখের চাহনি সহ্য হয় না কারো। চোখের তীর ভেঙে যায়। গড়িয়ে পড়ে নোনা জল। অন্ধকারের ঘ্রাণের সঙ্গে নোনা জলের মিল খুজতে চায় ছেলেটা।
মূল লেখাটা বন্ধুসভায়
দোকানপাট খুলেনি তখনো। ফোনে টাকা লোড দেয়ার জন্য ছেলেটার অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। সে ধীর পায়ে আবার চলে আসে চার তলায় তার নিজের ঘরে। ইদানিং প্রায় সব কাজেই শেষ পর্যন্ত তার কিছু করার থাকে না। খুব গভীর ও গভীতর বিষাদ তাকে ঘিরে রাখে।
সকাল গড়িয়ে শেষ দুপুরেও ছেলেটার আর বাইরে যাওয়া হয় না। ঘরের ভিতর আর বাহির তার কাছে বেশ দূরত্বের পথ হয়ে উঠে। তবে সে দূরত্ব খুব একটা বাড়তে পারে না। বিকেল যখন তার সর্বশেষ লেজটুকু নিয়ে দিনের সঙ্গে ঝুলে আছে, ঠিক তখন ছেলেটা বাইরে যায়। ছেঁড়া ফাটা এবং স্মৃতিমাখা মানিব্যাগের শেষ একশ টাকার নোটটা ভাঙাতে তার মন নড়ে উঠে। সেই সঙ্গে আরও নড়ে উঠে দুদিন পরেই চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাওয়ার শংকা।
রাতের খাবারে ডাল না থাকলে বড় অভিমান হয় ছেলেটার। হয় না বলে হতো বলা উচিৎ। কারণ এখন তো কোনো দিন পুরো ডাল না খেয়েই কাটাতে হয় তার। আজ হঠাৎ তবু বাড়ীতে রোজ রাতে ডাল খাওয়ার পুরোনো অভ্যেসটার কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেটার শুষ্ক ঠোটে অকৃত্রিম একটা হাসি খেলে যায়। সে হাসিতে খুব অবধারিতভাবে বিষাদের নীল ছায়া পড়েই থাকে। আজ রাতে তাকে খেতে হচ্ছে পেপের এক বিদঘুটে ভাজি। বুয়া এই রান্নাটা কার কাছ থেকে শিখেছে, ভেবে ভেবে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে উঠে তার। মন খারাপ হলেও অদ্ভুদভাবে ছেলেটা তা প্রকাশ করে না। সে নিজে মনে করে এটা তার খুব বড় একটা শক্তি হয়ে উঠেছে। অথচ আগে তো খুব সামান্য মন খারাপেও কেঁদে ফেলতো সে। নতুন অর্জিত শক্তিটা তাই তার খুবই ভালো লাগে।
পড়ালেখা বেশ জমে গেছে। বাধ্য হয়েই আজকাল ছেলেটার পড়তে হয়। এক সময় সে খুব পরিশ্রমী ছাত্র ছিলো। অথচ সেটা এখন সে মনেই করতে চায় না। তবুও কখনো মনে হয়ে গেলে সে এখনকার নিজের সঙ্গে আগের নিজেকে একটুও মেলাতে পারে না। আর এই মেলাতে না পারাটাই সাম্প্রতিক সময়ে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সংকট।
বই নিয়ে বসতে না বসতেই বিদ্যুৎ চলে যায়। শীথানেই বই রেখে দেয় সে। তারপর এক সপ্তাহ ধরে বিছিয়ে রাখা বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে সে ভাবে আগামীকাল বিছানা উঠিয়ে ঘরটা একবার ঝাড়ু দিতে হবে। দুই বছর ধরে মারাত্মক রকম ইনসমনিয়ায় ভোগা ছেলেটার ঘুম আসে না। আসার কথাও না। বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়া যে তার জীবন থেকে উধাও হয়ে গেছে আড়াই বছর আগে। ফেলে আসা গত আড়াইটা বছরই জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়ে গেছে। ছেলেটা তাই মনে করে। রাতের শুরুর ভাগে জানলা দিয়ে এসে পরা ঠান্ডা বাতাসকে ছেলেটার কাছে স্রষ্টার বিশেষ দয়া মনে হয়। সেটা আরো বেশি উপলব্ধি করা যায় যখন বাতাসটা এসে পরে ভ্যাপসা গরমে ভরা ঘরটাতে। ছেলেটার ভাবতে ইচ্ছে করে হঠাৎ আসা এই বাতাসে প্রিয় কারো গায়ের ঘ্রাণ আছে কি না। ইচ্ছেটাকে সে যত্ন করে এড়িয়ে যায়।
এড়িয়ে যেতে পারাটাকেও আজকাল সে নিজের অর্জিত বিশেষ ক্ষমতা বলে মনে করে। যে ক্ষমতার সবিশেষ ব্যবহারে সে এড়িয়ে যেতে পারে জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়াকেও। যেমন এই মুহুর্তে সে এড়িয়ে যাচ্ছে তার স্ত্রীকে, ফোন করার ইচ্ছেটাকে। তবে এটাই তার জীবনের সব চেয়ে বড় চাওয়া কি না, সে বিষয়ে ছেলেটা সন্দিহান। কথা ছিলো তার স্ত্রী তার সঙ্গে থাকবে। কেনো থাকছে না, তা একটা বিস্ময়। বিস্ময় না বলে মহাবিস্ময় বলা উচিৎ। কারণ তাদের বিয়েটা প্রেমের। প্রেমের বিয়েতে কেবল একসঙ্গে থাকাটাই বড় লক্ষ্য হয়।
ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে রাতের অন্ধকার। আর ছেলেটা মোহিত হতে থাকে অন্ধকারের নোনা গন্ধে। শুনতে থাকে অন্ধকারের তরল সূর।
প্রতিটি রাতেই এমন হয়। রাত যতো বাড়ে ছেলেটার মনোজাগতিক ভাবনাও ততোই অলৌকিক ও অস্বাভাবিক হতে থাকে। যদিও সে মনে করে তার সব স্বাভাবিক। হতেও পারে অন্যদের কাছে তা স্বাভাবিক নয়। আর একজনের স্বাভাবিকতা যে অন্যদের কাছেও তার মতোই হবে, এমন তো নয়। গাঢ় থেকে গাঢ়তর অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে ছেলেটা মাতাল হতে থাকে নোনা গন্ধে আর তরল সূরে।
প্রচন্ড অভিমান করে চলে যাওয়া স্ত্রী ঘুমের ঘোরে ছেলেটার কাছে চলে আসে। ফর্সা লম্বা আঙুল চালিয়ে দেয় ছেলেটার চুলে। একেবারে অজান্তে তার মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে সুখের শব্দ। ঘুমের মধ্যে আরো বেশি করে ঘুমায় সে। ঘুমের গভীরতা বাড়তে থাকে। বাড়তেই থাকে। ছেলেটা বেমালুম ভুলে যায় শেষ কবে এতো এতো ঘুমে রাত কাটিয়েছে সে। ঘুমের অনন্ত অতল ছোঁয়ার দূর্নিবার নেশা যেনো তাকে জড়িয়ে ফেলেছে। বহু দিন পর প্রিয় চোখের চাহনি সহ্য হয় না কারো। চোখের তীর ভেঙে যায়। গড়িয়ে পড়ে নোনা জল। অন্ধকারের ঘ্রাণের সঙ্গে নোনা জলের মিল খুজতে চায় ছেলেটা।
মূল লেখাটা বন্ধুসভায়
Comments
Post a Comment