সে যেভাবে আমার সাথে থাকে

আশুলিয়া, সাভার

শোনো, আমি তোমাকে আর একটাই কথা বলবো। প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। আমাকে আর জ্বালিয়ো না।

এই কথা বলে আব্বা আমাকে ধমকানো শুরু করলেন। আব্বা কতো দ্রুত তার একটা কথা শেষ করবেন, আমি সেই অপেক্ষায় রইলাম। লজ্জায় আমার শরীর অবস হয়ে আসছে। কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। কেউ একটু মনোযোগ দিয়ে তাকালেই দেখতে পাওয়ার কথা।

আমি জানি না উপরের ঘর থেকে রুবা তাকিয়ে আছে কি না। তাকিয়ে থাকলে ও হয়তো আমার লাল হয়ে যাওয়া মুখটাও দেখতে পাচ্ছে। ও এই বাড়িতে আসার পর আমি আব্বার সামনে এইভাবে, যাকে বলে রামধোলাই, তা কখনো খাইনি। আজ খাচ্ছি। খেতে হচ্ছে এবং সেটা ওরই কারণে।

রুবা যদি উপরের ঘর থেকে আব্বা আমাকে কী কী বলছেন, তা শোনার চেষ্টা করে, তবে ওর দুইটা উপলব্ধি হবে। একটা ওর জন্য লজ্জার। আরেকটা আমার জন্য। একটা উপলব্ধি হলো, যেটা ওর জন্য লজ্জার ও দেখবে ওর স্বামী এই বয়সেও বাবার সামনে কেমন ভয়ে কুকড়ে যায়।

আরেকটা ব্যাপার হলো, আমি যে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে আব্বার কাছে ধরা খেয়ে গেছি, সেটা ও জেনে যাবে। যা ওর কাছে আমাকে চিরদিনের জন্য লজ্জিত করে দিবে। আমি জানি না, এই ঘটনা জানার পর ও আর আমার সাথে থাকবে কি না।

আমার জীবনের যতো মেয়েঘটিত ব্যাপার আছে, আব্বা সব একটা একটা করে বলা শুরু করলেন। কোন ঘটনা তার জন্য কেমন অপমানের হয়ে এসেছিলো,  সবিস্তারে বর্ণনা করতে লাগলেন সে ইতিহাসও।

আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে, আব্বা ওইগুলো দয়া করে আর না বলেন। এখন যেটার জন্য ধরছেন, সেটা বলে বিদায় করে দেন। আমি মাফ চাই।

স্বাভাবিকভাবেই আমি এই কথাটা আব্বাকে বলতে পারলাম না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকাটাকেই মনে হলো একমাত্র উপযুক্ত কাজ। আমার দুই চোখ আমার পায়ের বুড়ো আঙুলে। খুব ইচ্ছা করছে মাথাটা উঁচু করে একটু উপরের দিকে তাকাই। দেখি রুবা আমাকে এই রকম অপদস্থ হতে দেখছে কি না। কিন্তু তাকাতে পারছি না। আব্বার সামনে এই মুহূর্তে মাথা উঁচু করে অন্য দিকে মনোযোগ দেয়ার স্পর্ধা আমার নেই।

নাদিয়ার সঙ্গে আমার ঝামেলাটার জন্য আব্বা কার কার কাছে অপমানিত হয়েছিলেন, তা তিনি বলতে শুরু করলেন। আমার প্রথম প্রেম ছিলো সে। আমি তাকে তুমি করে বলতাম। সে বলতো তুই করে। এক ক্লাসের ছিলাম দুজনে। তার তুই করে বলায় আমার খুব আপত্তি ছিলো। কিন্তু সে পাত্তা দিতো না।

নাদিয়ার মা আব্বার কাছে এসেছিলো বিচার নিয়ে। বলেছিলো, আপনার ছেলে ইমরান তো আমাদের মান- সম্মান কিছুই রাখলো না। বাচ্চা মেয়েটাকে সে কী বুঝিয়ে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে! আপনি একটু ব্যাপারটা দেখেন। আপনার ছেলেও তো বাচ্চা মানুষ। এতো এমন হলো কিভাবে?

আব্বা নাদিয়ার মার কথায় কোনো উত্তর দেননি। খুব লজ্জা পেয়েছিলেন। ভদ্রলোক হিসেবে দশ গ্রামের লোক আব্বাকে এক নামে চিনে। সেই তার ছেলে এক মেয়েকে পটিয়েছে, তার বিচার নিয়ে এসেছেন মেয়ের মা; ওই অপমানটা আব্বা ভুলতে পারেননি।

নাদিয়াজনিত ঝামেলার কথা শেষ করার পর আব্বার মনে পড়লো শিনুর কথা। মুন্সিগঞ্জের মেয়ে। আমাদের এলাকায় চাকরি করতো তার বাবা। তার সঙ্গে কিভাবে যেনো আমার একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো। সে ছিলো বয়সে আমার চেয়ে একটু বড়। একদিন বাসে করে কোথাও যাচ্ছিলাম। শিনুকে নিয়ে বাড়ির স্টেশন থেকে যেই বাসে উঠেছি, অমনি দেখি রাস্তার উল্টো পাশ থেকে আব্বা দৌড়ে আসছেন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে আমি প্রায় শিনুর ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকতে গেলাম। কেমন হলো— ভেবে জানলা দিয়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে ইচ্ছে করলো একবার। কিন্তু করা হলো না কোনোটাই। এর মধ্যেই আব্বা উঠে পড়লেন আমাদের বাসটাতেই।

শিনু আব্বাকে চিনতো না। আমি সামনের সিটে হাতটা রেখে বসে ছিলাম। শিনু আমার হাতের উপর ঝুলিয়ে রেখেছিলো তার হাত। আব্বা এসে এইভাবে আমাকে দেখলেন। আমি আক্ষরিক অর্থেই মূর্তি হয়ে গেলাম। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলাম আব্বার দিকে। আব্বাও তখন বিভ্রান্ত। চোখে চোখ পড়ে গেছে, কী বলবেন বা কী করবেন, তা নিয়ে তিনিও তখন দ্বিধান্বিত। বললেন, ইমরান, কই যাও? এই তো সামনে। আমি বললাম।

আব্বা কখনো ডাকলে বা কিছু জিজ্ঞেস করলে, আমি উত্তর দেয়া শুরু করি ‘আব্বা’ বলে। সে দিন আব্বা বলতেও ভুলে গিয়েছিলাম এবং আব্বার ভয়েই!

নাদিয়া ও শিনুর স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে আব্বা কিছুক্ষণ ঝাড়লেন আমাকে। এরপর শুরু করলেন আজকের ঘটনাটা।

আজ সিনেপ্লেক্স থেকে বের হচ্ছি, সঙ্গে ছিলো ফারজানা। সে আমার প্রেমিকা নয়। কোনো দিন ছিলোও না। তারপরও এই মেয়ে আমার হাত ধরে হাঁটছিলো। তার হাত ধরাটায় প্রেমিকার হাত ধরার সঙ্গে মিল নেই। যদিও সে বোধহয় আমাকে পছন্দ করে এবং জানে, সে আমাকে পছন্দ করলেও আমি কোনোদিন তার পছন্দে সাড়া দিবো না।

সিনেপ্লেক্স থেকে বের হয়ে প্রথম এস্কেলেটরটা পেরিয়ে পড়লাম আব্বার সামনে। বিকেল সাড়ে চারটায় তিনি বসুন্ধরা সিটিতে কী করছিলেন, তা আমি জানি না। এবার আব্বা কিছু বললেন না। চোখে চোখ পড়ে গেছে। সরিয়ে নেয়ার উপায় নেই। আমি বললাম, আব্বা, হঠাৎ এখানে এলেন..! কী কাজে… আমাকে বললেই পারতেন। আব্বা বললেন, এমনিই। তোমার চাচার সঙ্গে এসেছি একটা কাজে। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। আব্বার একপাশে ছোট চাচা দাঁড়িয়ে আছেন। তার দৃষ্টি ফারজানার দিকে।

২০ সেকেন্ডের দর্শনপর্বের পর আব্বা আমার নেমে আসা এস্কেলেটরে বিপরীতটা দিয়ে উপরে উঠে গেলেন। আমি ফারজানার সঙ্গে বাইরে এলাম। ভয়ে হয়তো কাঁপছিলামও। কিন্তু ফারজানাকে বুঝতে দিলাম না। 

এই মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় রুবার মাধ্যমে। রুবার কলেজের বান্ধবী। কদিন আগে রুবা একে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো। তখন সে আমার ফোন নম্বরও নিয়ে গিয়েছিলো। একদিন ফোন করে বললো, আমার সঙ্গে একটা ছবি দেখতে চায়। বললাম ঠিক আছে। এরপর রুবাকেও নিয়ে এলাম একদিন। তিনজন মিলে সিনেপ্লেক্সে একটা ছবিও দেখলাম। রুবা যদি একে আমার সঙ্গে পরিচয় করে না দিতো, এই রকম কিছু হতো না।

আরো একদিন ফোন করে আমার সঙ্গে ছবি দেখার আবদার জানালো সে। দেখলাম। এরপর আরো একবার। সেই একবারটাই ঘটলো আজ। আজকে যে আমি ফারজানার ডাকে, তাকে নিয়ে ছবি দেখতে গেছি, এটা রুবা জানতো না।

এখন বোধহয় জেনে গেছে। আব্বা অন্তত আধঘণ্টা ধরে আমাকে বকে যাচ্ছেন। আর আমার প্রেমিকা, প্রায় প্রেমিকা ও অ-প্রেমিকা; যতো মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো, যাদের কথা আব্বা কিভাবে কিভাবে যেনো জেনে গিয়েছিলেন, সবার নাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন। রুবা যদি উপরের ঘর থেকে আবার সঙ্গে আমার এই ‘অপদস্থায়নের’ দিকে নজর দিয়ে থাকে, তবে এতক্ষণে সব জেনে গেছে সে। সঙ্গে ফারজানার সঙ্গে আজ আমার ছবি দেখতে যাওয়ার কথাটাও।

শেষ দুই মিনিট ধরে আব্বার একটা কথাও আমার কানে যাচ্ছে না। পা ব্যথা করছে। ঘাড় ধরে আসছে। ইচ্ছা করছে, আব্বার পায়ে লুটিয়ে পড়ি। এবারকার মতো ছেড়ে দিতে বলি। কিন্তু আমার এই ইচ্ছেটা যথারীতি ভিতরেই বন্দি থাকলো।

আরো কয়েক মিনিট যাওয়ার পর আব্বা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার এতো কথা বলতে ভালো লাগে না। তোমাকে আর একটা কথাই বলবো।

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আবার একটা কথা! নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হলো আমার। ফারজানার নম্বরটা ব্লক করে দিবো। এই মেয়ের ডাকে সাড়া দেয়া দূরে থাক, কখনো তার ফোনই ধরবো না। আমি আব্বার একটা কথা শুরুর আগেই এই প্রতিজ্ঞাটা করে ফেললাম।

আব্বা শুরু করলো, শোনো… আমি বলতে না দিয়ে শুধু বললাম, আব্বা…

চুপ করো বেয়াদব। মুখে মুখে কথা বলো। বেশি বড় হয়ে গেছো? এখন তোমাকে একটা কথাও বলা যায় না। প্রায় চিৎকার করে উঠলেন আব্বা। রুবা যদি এতক্ষণ আমার এমন বিপদগ্রস্ত পরিণতি নাও দেখে থাকে, তবে এখন ঠিকই দেখছে। আব্বার চিৎকারের পর আর সে ঘরে বসে নেই। তার সঙ্গে হয়তো মা আর ফারিহাও আমার অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকাটা দেখে ফেলছে। ফারিহা আমার ছোটবোন। আমার সবচেয়ে কট্টর সমালোচক।

আব্বা আরো চিৎকার করে বললেন, বেয়াদব কোথাকার। যাও এখান থেকে। আমি এক মুহূর্তও আর দেরি করলাম না। মস্তক অবনত রেখেই সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। একসঙ্গে দুইটা করে ধাপ পার হয়ে ঘরে চলে গেলাম।

রুবা ঘরে নেই। বারান্দায়ও নেই। মানে আমার অবস্থাটা এতক্ষণ সে দেখেনি। আবার এমনও হতে পারে, আমি হেঁটে ঘরের আসার সময় সে সরে গেছে। কিন্তু সরে যাবে কোথায়? ঘরেই তো ঢুকবে। ঘরে তো নেই। মার ঘরে কি গেলো? আমি মার ঘরে যাবো কিনা বুঝলাম না। আব্বা নিশ্চয় ঘরে ঢুকে এখন রাগে কাঁপছেন।

আমি শার্ট খুলে খাটে শরীরটা আছড়ে ফেললাম। বাথরুমের দরজা খুলে রুবা বেরিয়ে এলো। আমি দ্রুত উঠে বসলাম। রুবার মুখটা শান্ত। চুল ভেজা। প্রতিদিনের বদঅভ্যাস, সন্ধ্যার পর গোসল করা, সেটা তিনি আরো একবার করে এলেন।

অন্যান্য দিন, সন্ধ্যার পর ভেজা চুলে বাথরুম থেকে বের হতে দেখলে তাকে আমি বকা দেই। আজ দিলাম না। দেয়ার মতো অবস্থাও ছিলো না। মানসিক শক্তিটাও না। আমি চুপ করে বসেই রইলাম। রুবা ড্রেসিংটেবিলের শান্ত হয়ে বসলো এবং চুল আচড়াতে শুরু করলো।

রুবার চুল আচড়াতে আট মিনিট সময় লাগে। এই আট মিনিট সে কোনো কথা বলে না। ৭ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড যদি আমি চিল্লিয়েও যাই, সে কোনো উত্তর পর্যন্ত দিবে না। ঠিক আট মিনিট এবং আজ আরো ৩৭ সেকেন্ড পর সে কথা বললো। ফারজানার সঙ্গে আর কয়বার ছবি দেখতে গেছো? হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হোঁচট খেলে যেমন হয়, ঠিক তেমন করে চমকে উঠলাম আমি। জিব শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।

আজই। আর কখনো যাইনি। সত্যি বলছি। বললাম আমি। এটা বলা ছাড়া উপায়ও ছিলো না। ফারজানার নাম ধরে যেহেতু রুবা জিজ্ঞসে করলো কয়বার ছবি দেখতে গেছি, সেহেতু সে আব্বা আমাকে যা বলেছে— তা যে শুনেছে, তা নিশ্চিত হলাম। মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম আর কিছু বিব্রতকর প্রশ্নের জন্য। যদিও আমি জানি না, সবগুলোর উত্তর আমার কাছে কি না।

সত্য বলছো মানে? গত সপ্তাহে কাকে নিয়ে গেছো? সোমবার তোমার প্যান্টের পিছনের বাঁ দিকের পকেটে দুটো ব্যবহৃত টিকেট পেয়েছি। সে দিন কাকে নিয়ে গেছো?

বিছানার চাদরটা টানটান না থাকলে রুবা অস্থির হয়ে থাকে। এই মুহূর্তে সে বিছানার চাদরটা এদিক ওদিক থেকে টেনে টেনে টানটান করছে এবং আমার সঙ্গে কথা বলছে। একবারের জন্যও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। রুবা যে দিনের কথা জিজ্ঞেস করছে, আমি সে দিন বলেছিলাম যে অফিসের কাজে বিকেলে একটু ব্যস্ত থাকবো। সে যাতে ফোন না দেয়। তারপর প্যান্টের পকেটে টিকিট পেয়েও সে আমাকে কিছু বলেনি। রুবার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে আমার মনে উল্টো প্রশ্ন জাগলো, টিকিট যে দিন পেলো, সে দিন কেনো জিজ্ঞেস করেনি।

প্রশ্নটা রুবাকে করলাম না। আমি জানি, এখন আমারই আরো ভয়ঙ্কর সব প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে। আমি খাটে বসে আছি। মোজা না খুলে কখনো খাটে আসি না। আজ এসে পড়েছি। রুবা টেনে মোজা জোড়া খুললো এবং বললো, উত্তর দিচ্ছো না কেনো?

দেখো, ফারজানার সঙ্গে আরো এক দুইবার ছবি দেখেছি। কিন্তু তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। থাকার প্রশ্নও আসে না। আমি তোমাকে নিয়েই সুখী। কোনো মতে বললাম আমি।

নাদিয়া বা শিনুর সঙ্গেও এমন সুখী হতে পারতে। ব্যাপার হলো, সব পুরুষই তার স্ত্রীর সঙ্গে সুখী হতে চায়। চাওয়াটা পূরণ হলেও তারা নিজেকে সুখী বলে দাবি করে, পূরণ না হলেও বলে বেড়ায় যে, আমি খুব সুখী। আমার স্ত্রী খুব ভালো মেয়ে।

রুবাকে এমন দর্শনসমৃদ্ধ কথা বলতে শুনিনি। তবে এখন ওর কথার দর্শন নয়, আমার কানে ও মনে তীরের মতো বিঁধলো নাদিয়া ও শিনুর নাম। রুবা যে আব্বা আমাকে যা যা বলেছে, সবই শুনেছে, সুনিশ্চিত হলাম।

নাদিয়ার নম্বরটা তোমার ফোনে নাদিম লিখে সেভ করা। আর শিনুর নম্বরটা শাহির নামে। তাই না? তুমি মাঝে মাঝেই ওদের সঙ্গে কথা বলো। তুই তোকারি করো। বন্ধুর মতো। ঠিক না?

আমি চুপ করে রইলাম। অন্য কোনো কথা বলার বা ওকে ভুল প্রমাণ করার কোনো চেষ্টাই করলাম না। সেটা সম্ভবও না। ও সত্যই বলেছে। কিভাবে ও এগুলো জানে, আমার মনে কোনো প্রশ্নও এলো না। আমি কেমন যেনো মস্তিষ্কশূন্য হয়ে পড়লাম। বুঝতে পারছিলাম কিছু বলা উচিত। কিন্তু কী বলবো, কী বলার আছে, ভেবে পেলাম না। মাথা নিচু করে বসে রইলাম।

খেতে চলো। শান্ত এবং স্বাভাবিক গলায় বললো রুবা। রেগে গেলে রুবা কী ভয়ানক হতে পারে, আমার জানা আছে। ও তখন চুপ হয়ে যায়। শান্ত হয়ে যায়। ভয়ঙ্কর স্বাভাবিক থাকে। চিৎকার চেঁচামেচি ওর চরিত্রে নেই। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, রুবার সিস্টেমে এই একটা ডিফেক্ট। এর চেয়ে চেঁচামেচি করলে আমি কোনোভাবে ম্যানেজ করে নিতে পারতাম। চুপ থাকা মানুষকে কিভাবে ম্যানেজ করা যায় আমি জানি না। রুবার সঙ্গে এক বছরের বেশি সময়েও শিখতে পারিনি।

আমি খাবো না। তুমি যাও। আমার এ কথার কোনো উত্তর দিলো না রুবা। ও সাধারণত এ রকম করে না। ভিতরে যতো ঝড়- তুফানই বয়ে যাক না কেনো, ও উত্তর দেয়। কথা বলে। কথা বন্ধ করে না। কিন্তু আজ কিছুই আগের মতো নয়।

আজ যা হচ্ছে সব নতুন। রুবা আমার খেতে যাওয়ার কথাটার কোনো উত্তর না দিয়ে শুয়ে পড়লো। রাত আটটাও বাজেনি। এর মধ্যেই শুয়ে পড়লো ও। আমি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না।

নাদিয়ার সঙ্গে আমি কথা বলি, সত্যই। শিনুর সঙ্গেও। কিন্তু কারো সঙ্গে, রাখা উচিত নয়, এমন কোনো সম্পর্ক আমার নেই। কথাগুলো রুবাকে বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বলতে পারছি না। আবার মনে হচ্ছে, যে সম্পর্ককে অনুচিত নয় বলে বিশ্বাস করছি, সেটা আসলেই কি তেমন? নাকি নিজের পাপ ঢাকতে আমার মন নিজের মতো ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নিচ্ছে সব কিছুর?

আমার খুব ইচ্ছে করলো আব্বার কাছে যাই। বলি যে একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। রুবা যদি আজ সারারাত এইভাবে চুপ করে থাকে, সকালে আমি মারা যাবো। হয়তো রাতেই, চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায়ই আমার প্রাণটা বেরিয়ে যাবে। রুবার চুপ করে থাকা সহ্য করা অসম্ভব।

আব্বা এতো কিছু না বলেও আমাকে বকতে পারতেন। কিন্তু তা না করে এক এক করে সব কিছু বলে দিলেন। রুবাও সব শুনলো। আব্বার উপর রাগ উঠতে থাকলো আমার। যদিও আমি কোনো দিনও এই রাগ আব্বাকে দেখাতে পারবো না। সেটা সম্ভবও না। আমার খুব অস্থির লাগছে এই মুহূর্তে। মার কাছে সব বলতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু মা তো সব ফারিহাকে বলে দিবে। ফারিহা আরো জ্বালিয়ে মারবে। আমার কি রুবার কাছেই ক্ষমা চাওয়া উচিত? ওকে বলা উচিত— আমি আর কখনো নাদিয়া বা শিনুর সঙ্গে কথা বলবো না। কখনো না।

রুবা আমার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে। এই পৃথিবীতে আমি যা কিছু সহ্য করতে পারি না, এটা সে রকম একটা ব্যাপার। কিন্তু কী করবো! প্রচণ্ড রকম ভয় ও পাপবোধ নিয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম। ঘড়ির কাঁটা মাত্রই আটটা পেরিয়ে গেলো। খুব ছোট থাকতে এই সময়ে শুয়ে পড়তাম। আজ নিজেকে সেই ছোটবেলার মতো লাগছে।

মাথাটা বালিশে রাখার পরই রুবা আমার দিকে ঘুরলো। পাতলা কাঁথাটা টেনে নিলো শরীরে। কাঁথাটার নিচে আমিও। নড়লাম না একটুও। রুবা চুলে হাত দিলো। হাত নাড়তে থাকলো। আমি ফোনটা হাতে নিলাম। ফারজানার নম্বরটা ব্লক করলাম এবং নাদিয়া ও শিনুর নম্বর দুটো ডিলিট করে দিলাম। রুবা খেয়াল করলো সব।

রুবা চুলে হাত নাড়ছে। আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসার কথা আমার। কিন্তু আজ ব্যাপারগুলো অন্য রকম। ভাবছি, এই মেয়েটা আমার সঙ্গে এভাবে কিভাবে থাকে! রাগ করলে বোঝা যায় না। বোঝা যা যায়, তাও হয়ে যায় ভুল। আমি যেনো কী কী ভাবা শুরু করলাম।


ক্ষুধা লাগলে চলো খেতে যাই। অনেক্ষণ পর বললো রুবা। আমি চুপ করে থাকলাম। একটু পর ওর দিকে মুখটা বাড়িয়ে দিলাম। আমার সম্ভবত ওর কপালে একটা চুমু দিতে ইচ্ছে করলো। 

Comments