ধানমণ্ডি ২৭ থেকে যে বাসে উঠলাম, সেটার নাম বিকল্প পরিবহন। মাথায় তখন প্রচণ্ড ব্যথা। এইভাবে টনটন করা মাথা ব্যথা বিগত কয়েক বছরে হয় নাই। আজ হলো। এই মাথা ব্যথার কোনো নাম নাই। নাম না থাকা এই যন্ত্রণাকে যতো ভয় পাই, সে রকম ভয় অন্য কিছুকে পাই না।
সে যাই হোক। বিকল্প পরিবহন আমাকে মিরপুর দশে নিয়ে যাবে। আপাতত এটুকুই জানি। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এই রকম ঝিরঝিরে বৃষ্টি আমার পছন্দ হওয়ার কথা। আগে হতোও। কিন্তু এখন হয় না। এখন মানে এই বাসে উঠে উঠার পর না কিন্তু। এখন মানে হলো, বিগত কয়েক বছর।
প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হলে আমার ঘুম ধরে খুব। পুরো পৃথিবী ভেঙে দুই টুকরা হয়ে আমার দুই চোখের পাতায় ঝুলে পড়ে। চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসে। আমি যতোই টেনেটুনে খুলে রাখার চেষ্টা করি, দুই ভাগ হওয়া পৃথিবী ততোই হেলতে থাকে। দুলতে থাকে। আর আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
চোখ বন্ধ হয়ে গেলে ঘুমিয়ে পড়তে বেশিক্ষণ লাগে না। খুব দীর্ঘ পথ না হলে, আমার বাসে ঘুমিয়ে পড়া বিরল ব্যাপার। ধানমণ্ডি ২৭ থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত আসতেও আমার ঘুমানোর কথা না। কিন্তু আজ আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রোজা রাখার ক্লান্তি এবং প্রচণ্ড মাথা ব্যথার যন্ত্রণা; এই দুইয়ের কাছে কাবু হয়ে বিকল্প পরিবহনের বহু ক্ষতের সিটে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুম যখন ভাঙে, তখন জানলা যা দিয়ে যা দেখা যায়, তাকে ঠিক ১০ নম্বর মনে হয় না। কিন্তু হেলপার বলে যাচ্ছে যে, তাদের বাস দশ নম্বর এসে পড়েছে। আমি তাড়াতাড়ি নেমে যাই। যে ব্যাগটা কাঁধে থাকার কথা, সেটা কোনোমতে হাতে ঝুলিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ি।
আমার তখনও ভালো করে ঘুমটা ভাঙেনি। আমার তখনও মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। ক্রমশ ঘোলা হয়ে আসা চশমার কাঁচ দিয়ে স্পষ্ট করে কিছুই দেখতে পারি না। এই যখন পরিস্থিতি, মিরপুর দশকে ভালো করে চেনার চেষ্টা করি।
প্রতিদিন যে লিচুওয়ালা চাচার সঙ্গে চোখাচোখি হয়, আজ সে নাই। প্রচণ্ড মাথা ব্যথার দিনে আগেও এমন হয়েছে, খুব চেনা জানা ব্যাপারগুলো আমার সামনে থেকে উধাও গেছে।
আজও তাই হলো বোধহয়। আমি জানি না। লিচুওয়ালা চাচা এতোগুলো লিচু নিয়ে কোনদিকে উধাও হলো! চাচার জন্য আমার খারাপ লাগতে শুরু করে।
মাথা ব্যথার সঙ্গে খারাপ লাগা মিশে, আমার অবস্থা বড় করুণ হয়ে উঠে। হাতে ঝুলতে থাকা ব্যাগটাকে ধাক্কা দিয়ে পিঠের উপর নিয়ে রাখি এবং এদিক ওদিক তাকিয়ে চাচাকে খুঁজি। পাওয়া যায় না।
চাচাকে বাদ দিয়ে আমার এখন রিকশা খোঁজা উচিত। দশ নম্বরটাকে ঠিকঠাক চিনতে হলে ফলপট্টির মোড়ে রিকশাওয়ালাদের দেখা জরুরি। একটা দুইটা চশমার বন্ধ দোকান এবং খাবার দোকান পার হয়ে আমি যে জায়গায় দাঁড়ালাম, অন্যান্য দিন এখানেই ফলপট্টির মোড়টা থাকে। আজ নেই! মাথা ব্যথার পরিমাণটা মাপতে মাপতে আমার মনে হলো, এটা দশ নম্বর নয়। আমার নতুন করে দশ নম্বরের বাসে উঠা উচিত। আমি পা বাড়ালাম। যেখানে বাস থামে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম।
সাদা আর নীল রঙের আল্পনা আঁকা একটা বাস এসে থামলো আমার ঠিক সামনে। হেলপার বলছে, নিউ সাউথ ওয়েলস, সিডনি, ওয়ারি পার্ক… এই ওয়ারি পার্ক, নিউ সাউথ ওয়েলস, সিডনি।
ঘুম ঘুম চোখজোড়াকে যতোটা সম্ভব ফাঁকা করে হেলপারের দিকে তাকালাম। চেনা চেনা লাগে। যখন মানবকণ্ঠে চাকরি করতাম, একে উইনার বাসে দেখেছি। তখন পান্থপথ থেকে প্রতিদিন গুলাম যেতে হতো। উইনার বাসে ওকে বারবার দেখেছি। সে এখন সাদা- নীল আল্পনা আঁকে বাসে! কী সুন্দর বাস!
কিন্তু না চেনা এই ১০ নম্বর থেকে সিডনি পর্যন্ত রোড হলো কবে? ইচ্ছে করলো আজ বাসায় ফিরবো না। বাসে করে সিডনি চলে যাবো। ওয়ারি পার্কে যাবো। যেখানে আমার হয়তো কেয়ার সঙ্গে দেখা হবে। কেয়ার সঙ্গে দেখা হোক বা না হোক, ওয়ারি পার্ক তো দেখা হবে। যেহেতু আজ বাসেই যাওয়া যাচ্ছে, সেহেতু আর চিন্তা কী— ফিরে আসতেও নিশ্চয় সমস্যা হবে না।
এই সব ভাবতে ভাবতে আমি বাসটায় উঠতে গেলাম। হেলপার চেঁচিয়ে উঠলো। ভাই ভাঙতি না থাকলে উইঠেন না। আগে তিতা ভালো। আমি ওকে চিনলেও ও আজ আমাকে চিনছে না। মাথা ব্যথা হলে আমি অনেককে চিনি না। আজ দেখছি অন্যেরাও আমাকে ঠিক মতো চিনে না।
কী আর করা। আমি বললাম, ভাড়া কতো তোর? হেলপার বললো, ৩৮ টাকা। এতো কম টাকায় সিডনি যাওয়া যায়? বললাম আমি। হেলপার বললো, ভাই, এইটা সিটিং না। তাই একটু কম। ভাংতি আছে? আমি বললাম, হ, আছে। উঠতে দে।
পিছন দিকে একটা সিট খালি। দুই জনের সিট। একটায় বসে আছে স্টিভ স্মিথ! আমার অবাক লাগা উচিত। কিন্তু লাগলো না। স্মিথের বাড়ি নিউ সাউথ ওয়েলসেই। এই বাসে তার থাকাটা তাই বিস্ময়কর কিছু না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক লোকাল বাসে উঠলো কেনো? প্রশ্ন জাগলো মনে। উঠতেই পারে। বিপদ আপদ তো আর বলে আসে না। উত্তরও দিয়ে দিলো মন।
স্মিথের পাশে বসলাম। সে জানার কাঁচে হেলে পড়েছে। ঘুমাচ্ছে। লম্বা মানুষ। তার কাঁধটা বেঁকে গেছে একদিকে। ডাকলাম না। ক্লান্ত মনে হয়।
স্মিথের পাশে আমি বসতে না বসতেই বাসটা ছেড়ে দিলো। লোকাল বাস। সব সিট ভরে যাওয়ার আর কাউকে নেয়া হলো না। কেনো নেয়া হলো না বুঝলাম না। ধানমণ্ডি থেকে মিরপুর দশে ফেরার সময় মাঝে মাঝে আমি মিরপুর লিংকে ওঠার চেষ্টা করি। সব সিট ভরা থাকে বেশির ভাগ সময়। উঠতে পারি না। তখন খুব বিপণ্ণ লাগে। আজ, এই বাসে উঠতে না পেরেও হয়তো কারো কারো বিপণ্ন লাগছে। আমার তাদের জন্য খারাপ লাগতে শুরু করলো।
মাথা- ব্যথাটা কমেনি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। স্মিথ নাক ডাকছে। অস্ট্রেলিয়ানরাও এইভাবে ডাক নাকে! আমার একটু হাসি পেলো। কিন্তু হাসতে পারলাম না। হাসিটা ঠোঁট থেকে ফসে পড়ে গেলো সিটের তলায়। আমার পৃথিবী দুই টুকরা হয়ে ভেঙে গেছে। ঝুলে পড়েছে আমার চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম চলে এলো। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আমাদের বাস এগোচ্ছে ওয়ারি পার্ক, নিউ সাউথ ওয়েলস, সিডনির দিকে।
বেশিক্ষণ আমার ঘুমটা টিকলো না। ভেঙে গেলো। স্মিথ ঘুমাচ্ছে। বাইরে ঘন অন্ধকার। বৃষ্টি হচ্ছে কিনা দেখা যায় না। আমার দীপার কথা মনে পড়তে লাগলো।
দীপার সঙ্গে এইভাবে রাতের বসে করে আমার অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করে। যেখান থেকে আর ফেরা যাবে না কখনো। কিন্তু ইচ্ছেটা দীপার নেই। সেই প্রায়ই ট্রেনে চড়ে। এদিক ওদিক চলে যায়। জানলার পাশে সিট পড়ে। কিন্তু কখনো জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে আমার কথা ভাবে না। কদিন আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কার কথা ভাবো? সে বলে, বাইরে নাকি তাকায়ই না। কেমন একটা মেয়ে!
দীপার কথা ভাবতে ভাবতে আমার আবার ঘুম পেলো। স্মিথ এখনো ঘুমাচ্ছে। খুব ক্লান্ত মন হয়। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। মাথা ব্যথাটা কমেনি। আর কোনোদিন কমবে বলে মনে হচ্ছে না।
আবার যখন ঘুম ভাঙলো আমার, খেয়াল করলাম স্মিথের চোখজোড়া বন্ধ, কিন্তু ঠোঁট নড়ছে। পাশের সিট থেকে যতোটা সম্ভব, কানটা ওর কাছে নিলাম। সে বলছে Australians all let us rejoice/ For we are young and free/ We've golden soil and wealth for toil/ Our home is girt by sea... এই কথা আগে কোথাও ঠিক মতো শুনিনি। শুনতে ইচ্ছেও করলো না।
বাইরে নরম রোদ। রাস্তার এক পাশে শান্ত নদী। আরেক পাশে সিলেটের মতো মাঝারি আকারের অনেক অনেক বিল্ডিং। এই জায়গা আগে দেখিনি। নিউ সাউথ ওয়েলস এ রকম না নিশ্চয়। ওয়ারি পার্কও এমন নয়।
একটু পর স্মিথ নড়লো। বললাম, নামবেন নাকি ভাই? জ্বি। একটু পরেই নামবো। গেটের দিকে যাবো। স্মিথ বিশুদ্ধ বাংলায় বললো। এইবার অবাক লাগলো। কী ভালো ছেলে। অস্ট্রেলিয়ার বিদঘুটে উচ্চারণে ইংরেজি তো পারেই, বাংলাটাও শিখে নিয়েছে। ভালো ছেলে।
আপনি যেখানে নামবেন, সে জায়গার নাম কী? আমি স্মিথকে বললাম। স্মিথের চোখ ফুলে আছে। রাতভর ঘুমালেও ঘুম তার ভালো হয়নি। বললো- ওয়ারলেস। ওয়ারি পার্ক কোন দিকে জানেন? আমি বললাম। স্মিথ বললো, আসেন, আমার সাথেই নামেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম।
মিনিট দুয়েক পর আমরা নামলাম। এরপর স্মিথ আমার সঙ্গে আর কোনো কথা বললো না। বিদঘুটে উচ্চারণে অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজি একটা রিকশা ডেকে নিয়ে চলে গেলো। এই জায়গায় এইভাবে রিকশা আছে, জানতাম না। অবশ্য এই জায়গার কিছুই আমি জানি না।
দশ নম্বরে তো এই খালি এই খালি বলে রিকশা ডাকি। কিন্তু এখানে কিভাবে ডাকবো! স্মিথ কিভাবে ডাকলো, খেয়াল করিনি। এই খালির ইংরেজি কী হয়, মনে ভাবতে লাগলাম। হেই ব্লাঙ্ক..? এইটা কিছু হলো? রিকশাওয়ালা হাসবে না তো? আমি যখন এই সব ভাবছি, পাশে এসে থামলো এক রিকশা। বললো, কই যাবেন ভাই? আমি বললাম, ওয়ারি পার্ক।
রিকশায় চেপে বসার পর মনে হলো, এই রিকশাওয়ালা বাংলা পারে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম কেয়াকে চিনে কিনা। বললো চিনে। প্রচণ্ড মাথা ব্যথার মধ্যেও আমার আরাম লাগতে শুরু করলো। রিকশাওয়ালাকে বললাম, তাহলে কেয়া যেখানে থাকে, সেখানে চলেন। রিকশাওয়ালা, একটা মোড় ঘুরে কেয়ার দিকে যেতে শুরু করলো। আমার তখনও প্রচণ্ড মাথাব্যথা।
সে যাই হোক। বিকল্প পরিবহন আমাকে মিরপুর দশে নিয়ে যাবে। আপাতত এটুকুই জানি। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এই রকম ঝিরঝিরে বৃষ্টি আমার পছন্দ হওয়ার কথা। আগে হতোও। কিন্তু এখন হয় না। এখন মানে এই বাসে উঠে উঠার পর না কিন্তু। এখন মানে হলো, বিগত কয়েক বছর।
প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হলে আমার ঘুম ধরে খুব। পুরো পৃথিবী ভেঙে দুই টুকরা হয়ে আমার দুই চোখের পাতায় ঝুলে পড়ে। চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসে। আমি যতোই টেনেটুনে খুলে রাখার চেষ্টা করি, দুই ভাগ হওয়া পৃথিবী ততোই হেলতে থাকে। দুলতে থাকে। আর আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
চোখ বন্ধ হয়ে গেলে ঘুমিয়ে পড়তে বেশিক্ষণ লাগে না। খুব দীর্ঘ পথ না হলে, আমার বাসে ঘুমিয়ে পড়া বিরল ব্যাপার। ধানমণ্ডি ২৭ থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত আসতেও আমার ঘুমানোর কথা না। কিন্তু আজ আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রোজা রাখার ক্লান্তি এবং প্রচণ্ড মাথা ব্যথার যন্ত্রণা; এই দুইয়ের কাছে কাবু হয়ে বিকল্প পরিবহনের বহু ক্ষতের সিটে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুম যখন ভাঙে, তখন জানলা যা দিয়ে যা দেখা যায়, তাকে ঠিক ১০ নম্বর মনে হয় না। কিন্তু হেলপার বলে যাচ্ছে যে, তাদের বাস দশ নম্বর এসে পড়েছে। আমি তাড়াতাড়ি নেমে যাই। যে ব্যাগটা কাঁধে থাকার কথা, সেটা কোনোমতে হাতে ঝুলিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ি।
আমার তখনও ভালো করে ঘুমটা ভাঙেনি। আমার তখনও মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। ক্রমশ ঘোলা হয়ে আসা চশমার কাঁচ দিয়ে স্পষ্ট করে কিছুই দেখতে পারি না। এই যখন পরিস্থিতি, মিরপুর দশকে ভালো করে চেনার চেষ্টা করি।
প্রতিদিন যে লিচুওয়ালা চাচার সঙ্গে চোখাচোখি হয়, আজ সে নাই। প্রচণ্ড মাথা ব্যথার দিনে আগেও এমন হয়েছে, খুব চেনা জানা ব্যাপারগুলো আমার সামনে থেকে উধাও গেছে।
আজও তাই হলো বোধহয়। আমি জানি না। লিচুওয়ালা চাচা এতোগুলো লিচু নিয়ে কোনদিকে উধাও হলো! চাচার জন্য আমার খারাপ লাগতে শুরু করে।
মাথা ব্যথার সঙ্গে খারাপ লাগা মিশে, আমার অবস্থা বড় করুণ হয়ে উঠে। হাতে ঝুলতে থাকা ব্যাগটাকে ধাক্কা দিয়ে পিঠের উপর নিয়ে রাখি এবং এদিক ওদিক তাকিয়ে চাচাকে খুঁজি। পাওয়া যায় না।
চাচাকে বাদ দিয়ে আমার এখন রিকশা খোঁজা উচিত। দশ নম্বরটাকে ঠিকঠাক চিনতে হলে ফলপট্টির মোড়ে রিকশাওয়ালাদের দেখা জরুরি। একটা দুইটা চশমার বন্ধ দোকান এবং খাবার দোকান পার হয়ে আমি যে জায়গায় দাঁড়ালাম, অন্যান্য দিন এখানেই ফলপট্টির মোড়টা থাকে। আজ নেই! মাথা ব্যথার পরিমাণটা মাপতে মাপতে আমার মনে হলো, এটা দশ নম্বর নয়। আমার নতুন করে দশ নম্বরের বাসে উঠা উচিত। আমি পা বাড়ালাম। যেখানে বাস থামে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম।
সাদা আর নীল রঙের আল্পনা আঁকা একটা বাস এসে থামলো আমার ঠিক সামনে। হেলপার বলছে, নিউ সাউথ ওয়েলস, সিডনি, ওয়ারি পার্ক… এই ওয়ারি পার্ক, নিউ সাউথ ওয়েলস, সিডনি।
ঘুম ঘুম চোখজোড়াকে যতোটা সম্ভব ফাঁকা করে হেলপারের দিকে তাকালাম। চেনা চেনা লাগে। যখন মানবকণ্ঠে চাকরি করতাম, একে উইনার বাসে দেখেছি। তখন পান্থপথ থেকে প্রতিদিন গুলাম যেতে হতো। উইনার বাসে ওকে বারবার দেখেছি। সে এখন সাদা- নীল আল্পনা আঁকে বাসে! কী সুন্দর বাস!
কিন্তু না চেনা এই ১০ নম্বর থেকে সিডনি পর্যন্ত রোড হলো কবে? ইচ্ছে করলো আজ বাসায় ফিরবো না। বাসে করে সিডনি চলে যাবো। ওয়ারি পার্কে যাবো। যেখানে আমার হয়তো কেয়ার সঙ্গে দেখা হবে। কেয়ার সঙ্গে দেখা হোক বা না হোক, ওয়ারি পার্ক তো দেখা হবে। যেহেতু আজ বাসেই যাওয়া যাচ্ছে, সেহেতু আর চিন্তা কী— ফিরে আসতেও নিশ্চয় সমস্যা হবে না।
এই সব ভাবতে ভাবতে আমি বাসটায় উঠতে গেলাম। হেলপার চেঁচিয়ে উঠলো। ভাই ভাঙতি না থাকলে উইঠেন না। আগে তিতা ভালো। আমি ওকে চিনলেও ও আজ আমাকে চিনছে না। মাথা ব্যথা হলে আমি অনেককে চিনি না। আজ দেখছি অন্যেরাও আমাকে ঠিক মতো চিনে না।
কী আর করা। আমি বললাম, ভাড়া কতো তোর? হেলপার বললো, ৩৮ টাকা। এতো কম টাকায় সিডনি যাওয়া যায়? বললাম আমি। হেলপার বললো, ভাই, এইটা সিটিং না। তাই একটু কম। ভাংতি আছে? আমি বললাম, হ, আছে। উঠতে দে।
পিছন দিকে একটা সিট খালি। দুই জনের সিট। একটায় বসে আছে স্টিভ স্মিথ! আমার অবাক লাগা উচিত। কিন্তু লাগলো না। স্মিথের বাড়ি নিউ সাউথ ওয়েলসেই। এই বাসে তার থাকাটা তাই বিস্ময়কর কিছু না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক লোকাল বাসে উঠলো কেনো? প্রশ্ন জাগলো মনে। উঠতেই পারে। বিপদ আপদ তো আর বলে আসে না। উত্তরও দিয়ে দিলো মন।
স্মিথের পাশে বসলাম। সে জানার কাঁচে হেলে পড়েছে। ঘুমাচ্ছে। লম্বা মানুষ। তার কাঁধটা বেঁকে গেছে একদিকে। ডাকলাম না। ক্লান্ত মনে হয়।
স্মিথের পাশে আমি বসতে না বসতেই বাসটা ছেড়ে দিলো। লোকাল বাস। সব সিট ভরে যাওয়ার আর কাউকে নেয়া হলো না। কেনো নেয়া হলো না বুঝলাম না। ধানমণ্ডি থেকে মিরপুর দশে ফেরার সময় মাঝে মাঝে আমি মিরপুর লিংকে ওঠার চেষ্টা করি। সব সিট ভরা থাকে বেশির ভাগ সময়। উঠতে পারি না। তখন খুব বিপণ্ণ লাগে। আজ, এই বাসে উঠতে না পেরেও হয়তো কারো কারো বিপণ্ন লাগছে। আমার তাদের জন্য খারাপ লাগতে শুরু করলো।
মাথা- ব্যথাটা কমেনি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। স্মিথ নাক ডাকছে। অস্ট্রেলিয়ানরাও এইভাবে ডাক নাকে! আমার একটু হাসি পেলো। কিন্তু হাসতে পারলাম না। হাসিটা ঠোঁট থেকে ফসে পড়ে গেলো সিটের তলায়। আমার পৃথিবী দুই টুকরা হয়ে ভেঙে গেছে। ঝুলে পড়েছে আমার চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম চলে এলো। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আমাদের বাস এগোচ্ছে ওয়ারি পার্ক, নিউ সাউথ ওয়েলস, সিডনির দিকে।
বেশিক্ষণ আমার ঘুমটা টিকলো না। ভেঙে গেলো। স্মিথ ঘুমাচ্ছে। বাইরে ঘন অন্ধকার। বৃষ্টি হচ্ছে কিনা দেখা যায় না। আমার দীপার কথা মনে পড়তে লাগলো।
দীপার সঙ্গে এইভাবে রাতের বসে করে আমার অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করে। যেখান থেকে আর ফেরা যাবে না কখনো। কিন্তু ইচ্ছেটা দীপার নেই। সেই প্রায়ই ট্রেনে চড়ে। এদিক ওদিক চলে যায়। জানলার পাশে সিট পড়ে। কিন্তু কখনো জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে আমার কথা ভাবে না। কদিন আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কার কথা ভাবো? সে বলে, বাইরে নাকি তাকায়ই না। কেমন একটা মেয়ে!
দীপার কথা ভাবতে ভাবতে আমার আবার ঘুম পেলো। স্মিথ এখনো ঘুমাচ্ছে। খুব ক্লান্ত মন হয়। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। মাথা ব্যথাটা কমেনি। আর কোনোদিন কমবে বলে মনে হচ্ছে না।
আবার যখন ঘুম ভাঙলো আমার, খেয়াল করলাম স্মিথের চোখজোড়া বন্ধ, কিন্তু ঠোঁট নড়ছে। পাশের সিট থেকে যতোটা সম্ভব, কানটা ওর কাছে নিলাম। সে বলছে Australians all let us rejoice/ For we are young and free/ We've golden soil and wealth for toil/ Our home is girt by sea... এই কথা আগে কোথাও ঠিক মতো শুনিনি। শুনতে ইচ্ছেও করলো না।
বাইরে নরম রোদ। রাস্তার এক পাশে শান্ত নদী। আরেক পাশে সিলেটের মতো মাঝারি আকারের অনেক অনেক বিল্ডিং। এই জায়গা আগে দেখিনি। নিউ সাউথ ওয়েলস এ রকম না নিশ্চয়। ওয়ারি পার্কও এমন নয়।
একটু পর স্মিথ নড়লো। বললাম, নামবেন নাকি ভাই? জ্বি। একটু পরেই নামবো। গেটের দিকে যাবো। স্মিথ বিশুদ্ধ বাংলায় বললো। এইবার অবাক লাগলো। কী ভালো ছেলে। অস্ট্রেলিয়ার বিদঘুটে উচ্চারণে ইংরেজি তো পারেই, বাংলাটাও শিখে নিয়েছে। ভালো ছেলে।
আপনি যেখানে নামবেন, সে জায়গার নাম কী? আমি স্মিথকে বললাম। স্মিথের চোখ ফুলে আছে। রাতভর ঘুমালেও ঘুম তার ভালো হয়নি। বললো- ওয়ারলেস। ওয়ারি পার্ক কোন দিকে জানেন? আমি বললাম। স্মিথ বললো, আসেন, আমার সাথেই নামেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম।
মিনিট দুয়েক পর আমরা নামলাম। এরপর স্মিথ আমার সঙ্গে আর কোনো কথা বললো না। বিদঘুটে উচ্চারণে অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজি একটা রিকশা ডেকে নিয়ে চলে গেলো। এই জায়গায় এইভাবে রিকশা আছে, জানতাম না। অবশ্য এই জায়গার কিছুই আমি জানি না।
দশ নম্বরে তো এই খালি এই খালি বলে রিকশা ডাকি। কিন্তু এখানে কিভাবে ডাকবো! স্মিথ কিভাবে ডাকলো, খেয়াল করিনি। এই খালির ইংরেজি কী হয়, মনে ভাবতে লাগলাম। হেই ব্লাঙ্ক..? এইটা কিছু হলো? রিকশাওয়ালা হাসবে না তো? আমি যখন এই সব ভাবছি, পাশে এসে থামলো এক রিকশা। বললো, কই যাবেন ভাই? আমি বললাম, ওয়ারি পার্ক।
রিকশায় চেপে বসার পর মনে হলো, এই রিকশাওয়ালা বাংলা পারে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম কেয়াকে চিনে কিনা। বললো চিনে। প্রচণ্ড মাথা ব্যথার মধ্যেও আমার আরাম লাগতে শুরু করলো। রিকশাওয়ালাকে বললাম, তাহলে কেয়া যেখানে থাকে, সেখানে চলেন। রিকশাওয়ালা, একটা মোড় ঘুরে কেয়ার দিকে যেতে শুরু করলো। আমার তখনও প্রচণ্ড মাথাব্যথা।
Comments
Post a Comment