সাক্ষাৎ

সেলিমের সঙ্গে দেখা হলো প্রায় ত্রিশ বছর পর।

আট-নয় বছর বয়সে সর্বশেষবার যখন ওকে দেখেছিলাম, তখনকার চেহারা কেমন ছিলো বেমালুম ভুলে গেছি। কিন্তু সেলিম বলে যে আমার একজন বন্ধু ছিলো, তা কোনোদিন ভুলিনি। বরং আমি ওকে নানা সময়ে খুঁজে ফিরেছি। কিন্তু কোনোভাবেই খোঁজ মেলেনি। দেখা হওয়ার প্রশ্নও তাই ওঠেনি।

আমরা ভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একই শ্রেণিতে পড়তাম। বাড়ি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরের স্কুলে যেতাম হেঁটে হেঁটে। প্রতিদিনের এই দীর্ঘ হণ্টনযুদ্ধে সেলিম ছিলো আমার সহযোদ্ধা। একই গ্রাম থেকে প্রতিদিন সকালে স্কুলের পথে যাত্রা শুরু হতো আমাদের।

লোকে বলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব সহপাঠিই আসলে বন্ধু হয়ে যায়। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা হয় না। কিন্তু আমার বেলায় পরেরটা ঠিক হলেও, প্রথমটা অন্য রকম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আমার বন্ধু ছিলো হাতেগোনা কয়েকজন। সেলিম ছিলো তাদের মধ্যে বিশেষ। কারণ আমাদের দুই পরিবার রীতিমত অনুষ্ঠান করে আমাদের দোস্ত পাতিয়ে দিয়েছিলো। এখনকার বাচ্চারা এই দোস্ত পাতানো ব্যাপারটা কী তা জানে না।

দোস্ত পাতানোর জন্য কী ধরনের আনুষ্ঠানিকতা করা হয়েছিলো তা আর মনে নেই। কিন্তু সেলিম যে সহপাঠি বা বন্ধুর বাইরে আমার ‘দোস্তও’ ছিলো, সেটা ঠিক মনে আছে। দোস্ত পাতিয়ে দেওয়ার কিছুদিন পর থেকে আমাদের বাড়িতে সেলিমদের বাড়ি থেকে নানা উপহার সামগ্রী আসতে থাকলো। কখনো প্যান্ট-শার্ট। কখনো নাড়িকেলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া বা খই। একই উপহারসামগ্রহী আমাদের বাড়ি থেকেও সেলিমদের বাড়িতে যেতো।

কিন্তু হঠাৎ কী হলো জানি না সেলিম কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো।

একদিন স্কুল যাওয়ার পথে ওর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু ও আর আসে না। কিছুক্ষণ পর সেলিমের মা জানালেন আজ ও স্কুলে যাবে না। এই কথাটা সেলিম নিজেও আমাকে এসে বলতে পারতো। কিন্তু ওই বয়সে এই রকম ছোট বিষয় নিয়ে মন খারাপ হতো না।

স্কুলে যাবে না শুনে আমি একাই চলে গেলাম। দীর্ঘ পথ প্রায় একা একা পারি দিতে আমার কি ভয় করেছিলো? স্কুলে গিয়ে কি একা একা লাগছিলো? সে সব আজ আর মনে নেই!

পরদিন এবং তার পরদিনও একই ঘটনা ঘটলো। সেলিমের মা এসে আমাকে জানালেন ও স্কুলে যাবে না। কেনো যাবে না কিংবা আমি কেনো বাসায় ঢুকে সেলিমকে সরাসরি জিজ্ঞেস করিনি কে জানে।

কয়েকদিন পর আবিষ্কার করলাম ওই বাড়িতে সেলিমরা আর থাকে না! সেই শেষ। আর কোনো দিন সেলিমের সাথে আমার দেখা হয়নি।

এতো বছর আগের স্মৃতি মনে করে এখন খারাপ লাগছে। কিন্তু তখন, ওই ছোট্ট বয়সেও আমার মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো, এমন কিছু মনে পড়ছে না। কয়েকদিনের মধ্যেই আমি সেলিমের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমার ততোদিনে অনেক বন্ধু জুটে গেছে- সালাহউদ্দিন, শরিফ বা অন্য অনেকে।

কিন্তু সেলিম একেবারে আমার স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যায়নি। ওর কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়তো। কারণ ‘দোস্ত পাতানো’র ঘটনাটা আমার স্মৃতিতে ওর একটা স্থায়ী স্থান গড়ে দিয়েছিলো।

বহুদিন পর জানতে পারলাম সেলিমের বাবা সোলায়মান মোল্লা দুটি বিয়ে করেছেন। সেলিম হলো তার প্রথম ঘরের সন্তান। কোনো এক অজানা কারণে সেলিমের মা তার বাবাকে ছেড়ে চলে গেছেন। সম্ভবত দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টা তিনি কখনো মেনে নিতে পারেননি। সে যাই হোক, সেলিমের সাথে আমার আর দেখা হয়নি। ভেবেছিলাম কোনোদিন হবেও না।

কিন্তু পৃথিবীতে অনেক ঘটনার ব্যাপ্তি আসলে আমাদের দেখা বা জানার চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত হয়। ফলে যে ঘটনা শেষ হয়ে গেছে বলে আমরা মনে করি, বহু বছর পর দেখা যায় সেই ঘটনার নতুন অধ্যায় শুরু হয়। কিংবা নতুন রকম উত্তেজনা নিয়ে সামনে আসে পুরোনো অনেক কিছু।



আমার তখন প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। এই রকম ব্যথা মাঝে মাঝেই হয়। আমি জানি না পৃথিবীতে আর কারো এতো তীব্রভাবে মাথা ব্যথা হয় কি না। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দুই নম্বর টার্মিনালে বসে আছি। এ দিক ও দিক কোলাহোলে পূর্ণ। কিন্তু মাথা ব্যথার তীব্রতায় সে সবের কিছুই আমি টের পাচ্ছি না।

পাঁচ-ছয় বছর বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমার ব্যাকপ্যাকটা কোলের উপর। তার উপর দুই হাতের কণুই রেখে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। মেয়েটা ঠিক আমার কাছেই এলো।

তুমি কি বাংলা পারো? বাচ্চা মেয়েটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো।

আমি সামান্য মাথা দুলিয়ে তার চেয়েও সামান্য আওয়াজে মুখে যৎসামান্য হাসি নিয়ে বললাম, হ্যা, আমি তো বাংলা পারি!

বাচ্চাটা খুব খুশি হলো এবং দৌড়ে চলে গেলো। মাথা ব্যথার তীব্রতায় বাচ্চাটার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। ওর রঙিন জামা বড্ড কটকটে লাগছিলো।

প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হলে পৃথিবীটাকে একদম স্তব্ধ লাগে। চারপাশের শব শব্দই কানে আসে, কিন্তু সেই সব শব্দের সাথে মন ও মগজের সংযোগ ঘটে না। একটা টেনিস বল দেওয়ালে ছুড়ে মারলে তা যদি ঠিকঠাক ফিরে আসে, তাহলে সেটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু দেওয়ালে লেগে বলটা যদি আস্তে করে শুধু নিচে নেমে যায়, তাহলে কেমন? মাথা ব্যথার সময় দুনিয়ার সাথে আমার সম্পর্কটা দেওয়ালে লেগে আস্তে করে নিচে পড়ে যাওয়া টেনিস বলের মতো অস্বাভাবিক।

ঠিকঠাক কি বলা গেলো ব্যাপারটা? আসলে ওই মাথা ব্যথা বর্ণনা করা কঠিন। মানুষের কথা বলা বা লেখালেখি তৈরি হয় শুনে শুনে অথবা পড়ে পড়ে। আমি কোথাও কোনোদিন এই রকম মাথা ব্যথার বর্ণনা পড়িনি বা শুনিনি। ফলে বোঝাতেও পারছি না।

অশ্রুতপূর্ব সেই মাথা ব্যথা নিয়েই বিমানে উঠলাম। অন্যান্য দীর্ঘযাত্রায় বিমানে উঠেই সিট বেল্টটা বেঁধে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। কিন্তু কলকাতা থেকে ঢাকা আসার পথে সে উপায় নেই। এই অল্প পথ ভ্রমণে মাঝে মাঝে বিমানেরাও হয়তো বিরক্ত হয়।

ঢাকা এসে নামার পর কী এক বিপত্তি ঘটলো; আমাদের বিমানটি রানওয়ের দৌড় শেষে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আমার অবশ্য তাতে খুব একটা সমস্যা হলো না। বরং মাথা ব্যথাটা কম মনে হচ্ছে। এর মধ্যে ক্রুদের কেউ এসে আমাদের উঠতেও বললো না। দুই একজন উঠে পড়তেই সাউন্ড সিস্টেম থেকে বসে পড়ার অনুরোধ করা হলো।

এই নাটকীয়তা অবশ্য মিনিট দশেকের বেশি স্থায়ী হলো না। শুরু হলো বরং অন্য নাটক।

সেই বাচ্চা মেয়েটা আমার ফ্লাইটেই ঢাকা এসেছে। সাথে থাকা লোকের কোল থেকে নেমে পড়েছে সে। শুধু তাই না; এক ভো দৌড় দিয়ে চলে এসেছে আমার কাছে।

পেছন থেকে এক তরুণী অ্যাই অ্যাই করে ধমে উঠলেন। সম্ভবত বাচ্চাটার মা হবেন। আবার নাও হতে পারেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না এক সন্তানের মা হয়েছেন। আবার সেই সম্ভাবনা একদম উড়িয়েও দেওয়া যাচ্ছে না। এখনকার মায়েরা অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন। সন্তান হলেই মুটিয়ে যাওয়ার পুরোনো ব্যাপার আর নেই।

আমি হাত নেড়ে ওই তরুণীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম যে বাচ্চাটা আসুক, সমস্যা নেই।

নাম কী তোমার- আমিই এবার আগে কথা বললাম।

বাচ্চাটা সবিস্ময়ে দুই হাত মুখের দিকে টেন নিলো। আমি আস্তে করে মাথাটা তার দিকে আরো একটু ঝুঁকিয়ে বললাম- কী হয়েছে বলো তো বাবা!

তুমি সত্যিই বাংলা পারো? মেয়েটা খুব মিষ্টি করে বললো। ও সম্ভবত কলকাতায় প্রচুর হিন্দি শুনেছে। ফলে বিশ্বাস করতে পারছে না এইখানে বাংলা বলা একজন লোকের সাথে ও সরাসরি কথা বলতে পারবে!

আমি তাকে একটু কাছে টেনে বললাম- হ্যা, আমি তো সব বাংলা পারি। তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না!

তুমি কি বাংলাদেশে থাকো? আরো মিষ্টি করে মেয়েটা বললো।

হ্যা, আমি বাংলাদেশেই থাকি!

এর মধ্যে যাত্রীদের আস্তে আস্তে নেমে পড়ার অনুরোধ করা হলো। আমার বেশ কয়েক সিট সামনে বসা ওই তরুণী চিৎকার করে বাচ্চাটাকে ডেকে উঠলেন। আমি অবশ্য এর মধ্যেই এক হাতে ব্যাগ ও আরেক হাতে বাচ্চাটার হাত ধরে সামনে এগোনো শুরু করেছি। তরুণী আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। সে হাসির অর্থ- বাচ্চাটা খুব দুষ্টু।

ওই তরুণীর সাথে আরো একজন আছেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ। তাকে নামাতে হলো হুইলচেয়ারে বসিয়ে।



ইমিগ্রেশন পেরিয়ে বাইরে চলে এসেছি। বের হতে হতে জানতে পারলাম তরুণীই বাচ্চার মা। মেয়েটা এখনো আমার হাত ধরে আছে। আমার সাথে কথা বলতে পছন্দ করছে সে। আমার সাথে সাথে বেরিয়ে এসেছেন তার মা এবং হুইলচেয়ারে বসা লোকটাও।

বিদায় নেওয়ার সময় তরুণীটি সৌজন্যতার কাজ সারতে গিয়ে ধন্যবাদ বললেন এবং জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথায় থাকি। বললাম সাভার নামাবাজারের দিকে। বিস্ময় নিয়ে তিনি বললেন উনিও তো ওখানকারই ছেলে এবং বলতে বলতে হুইলচেয়ারে বসা লোকটার দিকে ইঙ্গিত করলেন।

আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম- হ্যালো, আমি আরিফ।

লোকটা সম্ভবত কথা বলতে পারেন না। তার হয়ে উত্তর দিতে দিলেন বাচ্চার মা- উনি সেলিম, আমার হাজব্যান্ড।

আমি হাসিমুখে বললাম- ও, আচ্ছা।

আমাকে নেওয়ার জন্য আমার পার্টনারের গাড়ি আসার কথা। এক ঘণ্টার মধ্যে আমাকে পূর্বাচলে থাকতে হবে। দেরি হয়ে গেলে হারাতে হবে নতুন একটা কন্টাক্ট। দুই পা এগিয়ে গাড়ি খুঁজতে লাগলাম।

তরুণীটিও হুইলচেয়ার একটু এগিয়ে এনে আমার পাশাপাশি দাঁড়ালেন। স্বগোক্তির মতো করে বললেন- উনার বাবার নাম সোলায়মান মোল্লা। আমরা অনেক আগে নামাবাজার থেকে চলে এসেছি। আর যাইনি বহুদিন।

সোলায়মান মোল্লা? স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরেই বললাম।

তরুণীটি বললেন- জ্বি।

আমি কিছু বলতে যাবো, এর মধ্যেই আমার ফোন বেজে উঠলো। গাড়ি চলে এসেছে। একেবারে সামনে দাঁড়ানো। আমি গাড়িতে উঠতে উঠতে হুইলচেয়ারে বসা সেলিমের দিকে একবার শুধু তাকাতে পারলাম।

Comments