কথা

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে এলো।

কতো গল্পে-উপন্যাসে এ রকম লাইন পড়েছি ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে আসাটা কেমন, তা আর আজকাল বোঝা যায় না। খুব ছোটবেলায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামতো। আমি দেখেছি। এখনো স্পষ্ট মনে আছে।

আজ সেই রকম আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে হলো হঠাৎ। গত কয়েক বছরে এপ্রিল মাসে দেখেছি কাঠফাটা রোদ। কিন্তু এবার অন্য রকম। প্রায় পুরো এপ্রিল মাস কেটে গেলো মেঘলা আকাশ আর বৃষ্টি মাথায় করে। রোদ দুই একবার দেখা গেছে বটে, কিন্তু তা গত কয়েক বছরের কাঠফাটা রোদের তুলনায় কিছুই না।

এমনই আকাশ ভাঙা বৃষ্টির দুপুরে, প্রায় অন্ধকার দুপুরে আমি জানলার গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে বৃষ্টির দিকে অপলক তাকিয়ে আছি। অলস দুপুরটা আরো বেশি আলসেমিতে মুড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই ঘটনাটা ঘটে গেলো। ফোন দিলো কেয়া।

মানুষের মনের সাথে বৃষ্টির এক অদ্ভুত সংযোগ আছে। প্রচুর বৃষ্টি হলে মন খারাপ হয়ে যায়। বিস্মৃতির অচলায়তন ভেঙে স্মৃতির পথ তকতকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কেয়ারও কি তাই হলো? ওর শহরেও কি বৃষ্টি হচ্ছে?

কী খবর? কেয়ার শান্ত কণ্ঠ। ফোন ধরে হ্যালো-ট্যালো কিছু বলিনি। কেয়াই কথা শুরু করলো।

ভালো আছি। ছোট্ট উত্তর দিলাম আমি। অবশ্য ওকে বলার মতো বড় কথা আর নেই আমার কাছে। প্রতিউত্তরে কেয়া হয়তো আশা করেছিলো ও কেমন আছে, তা জানতে চাইবো। আমার উচিত‌ও ছিলো তা জিজ্ঞেস করা। কিন্তু ও কী রকম আছে বা নাই, সে বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহ জন্মাচ্ছে না। আগ্রহের বাইরে গিয়ে আমি কিছু করতে পারি না।

আর কোনো কথা নাই? কেয়াই কথা বললো আবার।

আমি চুপ করে থাকলাম। ইচ্ছে করছিলো বলি- না, আর কোনো কথা নাই। কিন্তু সেটা বললাম না। অহেতুক কষ্ট দিতে ইচ্ছে করলো না কেয়াকে। আমি অবশ্য হেতু থাকলেও কাউকে কষ্ট দিতে পারি না। সত্য কথা বলতে কষ্ট দেওয়ার জন্য কোনো হেতু আমি তৈরিই করতে পারি না।

অথচ কেয়ার ফোন পেয়ে আমার আনন্দে নেচে উঠার কথা। আবেগে কেঁপে উঠার কথা। ইচ্ছেও করছে সে রকম কিছু হোক। আবেগ ব্যাপারটা এমন যে একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু নয়।

হ্যালো… আমার চুপ থাকায় যে সামান্য কয়েক মুহূর্তের নীরবতা নেমে এসেছিলো, তা ভাঙলো কেয়া।

হ্যা, হ্যালো। আমি এতোটাই নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললাম যে কয়েক বছর আগের কেয়া হলে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিতো। কিন্তু কিছুই আর আগের মতো নেই। কেউ-ই আগের মতো থাকে না। না কেয়া না আমি।

তোমার মনে হয় আমার সাথে কথা বলার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছেও নাই, তাই না?

আমার বিষয়ে কেয়ার প্রায় সব ধারণাই ঠিক হয়। আমার সাথে ওর দেখা না হওয়ার বয়স পনের বছরের বেশি হয়ে গেছে। এরপরও আমার মনমেজাজ পড়ার অভ্যাসটা সে ভুলেনি। আসলেই আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। একেবারেই যে ইচ্ছে করছে না, তা নয়। ইচ্ছে সামান্য ঠিকই করছে, কিন্তু আমি ঠিক কী বলবো তা খুঁজে পাচ্ছি না।

ফোনটা কানে ধরে চুপ করেই থাকলাম। আর চোখ পড়ে রইলো জানালার বাইরে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে। আমার জানলা থেকে ত্রিশ-চল্লিশ কদম দূরে একটা কড়ই গাছ। খুব ছোট বেলায় এই গাছের নিচে মার্বেল খেলে কাটিয়ে দিয়েছি কতো কতো বেলা।

গাছটার বয়স আমার চেয়ে খুব বেশি নয়। কিন্তু মানুষের মতো গাছও মনে হয় ক্লান্ত হয়। কিছু কিছু মানুষের জীবন যেমন একটু বেশিই ক্লান্তিকর, এই গাছটা মনে হয় সেই রকম ভাগ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছে। ফলে বয়স যতোটা না, একটু মনোযোগ দিয়ে তাকালে মনে হয় তার চেয়ে অনেক বেশি।

আমি চুপচাপ গাছটার দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছি। বাঁ হাতে ধরা ফোনটা কানের উপর রাখা। এভাবে কতক্ষণ সময় গেলো জানি না। আমার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছিলো।

আমার কি ফোনটা রেখে দেওয়া উচিত? কেয়ার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছিলো।

আমার মনে হয় সেটাই ভালো। আর এমনিতে আমাদের তো বলার মতো খুব বেশি কথাও নেই। শান্ত অথচ অত্যন্ত দৃঢ় গলায় আমি বললাম। বলতে বলতে ভেতরটা একটু কেমন কেমন করে উঠলো। কিন্তু কণ্ঠটা একদমই বিচলিত মনে হলো না।

কেয়া ফোন কেটে দিলো।

কিন্তু আমি ফোনটা কানেই ধরে রাখলাম এবং তীব্রভাবে আশা করলাম ফোনটা টেবিলে রেখে দেওয়ার আগেই কেয়া আবার ফোন করুক, বলুক- মাসুদ আমি তোমাকে এখনো প্রচণ্ড ভালোবাসি। তুমি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও।

আটত্রিশ বছর বয়সে এসে এই ধরনের আশা করা বোকামি। কেয়া আর ফোন দিলো না। সাবেক প্রেমিকা ফোন রেখে দেওয়ার পর, আটত্রিশ বছর বয়সে এসে তাকে আবার ফোন করতে লজ্জা করে। অথচ কেয়ার জন্য এক সময় আমার নির্লজ্জতার কোনো সীমা ছিলো না।

মানুষ যখন নিজেকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দিতে পারে, তখন মানুষ নির্লজ্জ হয়, তখন মানুষ বীরপুরুষ হয়। কিন্তু যখন বিলিয়ে দেওয়াটা যদি ভেতর থেকে না আসে, তাহলে লজ্জা এসে পথ বন্ধ করে দেয়।

কেয়াকে আবার ফোন করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। ও হয়তো ফোন ধরবে না। যদি ধরে তাহলে কী বলবো?

নাহ, ফোন আমি করলাম না। কিন্তু মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো।
কড়ই গাছটার উপর অবিরল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। সে দিকে স্থির তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু মনটা আর স্থির হলো না।

ছোটবেলায় এই রকম আকাশ ভাঙা বৃষ্টির দিনে আমাদের ঘরের শনের চাল চুয়ে চুয়ে পানি পড়তো। ভিজে যেতো ঘর-দুয়ার। সেই সময়ে এক মজার খেলা ছিলো আমার। মার ছোট রান্না ঘরে যে দুই একটা হাঁড়ি-পাতিল ছিলো, তা উঠানে ছড়িয়ে দিতাম। মুহূর্তেই বৃষ্টির পানিতে সেসব ভরে যেতো। সেই পানি ঘরে এনে কলস ভরে রাখতাম।

হঠাৎ মন খারাপে এই সব স্মৃতি মনে পড়তে থাকলো। কিন্তু কেয়ার কথা কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। আবার তাকে যে ফোন করে একটু কথা বলবো, তার জন্যও মন সায় দিচ্ছিলো না। এই অনুভূতি বড় অন্য রকম।

এইভাবে আরো কিছুক্ষণ সময় গেলো। বৃষ্টি কমে এসেছে। কড়ই গাছটাকে এই মুহূর্তে বড় বিষণ্ন লাগছে। যেনো বৃষ্টি কমে আসায় তার মন খারাপ হয়ে গেলো। বৃষ্টির সময় গাছটাকে চঞ্চল কিশোরের মতো লাগছিলো। এখন আবার ক্লান্ত-অবসন্ন লাগছে। যেনো বহুকাল দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গাছটার পা ধরে এসেছে।

আরো কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেলো। অন্ধকার ভাবটা কেটে আলো ঢুকলো জানলা দিয়ে। কিন্তু এই আলো মোটেও সহ্য হচ্ছিলো না।

আমার ঘরের দুই দিকে বড় দুই জানালা। দিনের বেলায় আলোতে ভরপুর থাকে বলে ঘরটা আমার বিশেষ পছন্দের। কিন্তু আপাতত আমার অন্ধকারে থাকতে ভালো লাগছে। দুই জানালারই পর্দা টেনে দিলাম। আলো একটু কমলো বটে, কিন্তু বৃষ্টির সময়ের মতো অন্ধকার আর হলো না। অন্ধকারের জন্য মন অস্থির হয়ে উঠলো।

এই মুহূর্তে আরো অন্ধকারে ডুব দেওয়ার জন্য কেয়াকে ফোন দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার থাকলো না।

দুইবার রিং হতেই ফোন ধরলো কেয়া।

তুমি ফোন করলে! বিশ্বাসই করতে পারছি না। কেয়ার উচ্ছাসটা টের পেলাম। কিন্তু উচ্ছসিত হওয়ার কী আছে বুঝলাম না। মানুষ যাকে ফেলে চলে যায়, তার ফোন পেয়ে কি আসলেই উচ্ছসিত হয়? যদি না হয়, এই মুহূর্তে কেয়ার কণ্ঠে যে উত্তাপ ভর করেছে, তা কোত্থেকে আসছে?

আচ্ছা, কেনো ফোন করেছিলে বলো। মনের অস্থিরতাটা যতোটুকু সম্ভব গোপন করে আমি বললাম।

তেমন কোনো কারণে নয়। এমনিই ফোন করলাম। প্যারিসে তুষার পড়ছে ইদানিং খুব। ঝড়ও আসছে যখন তখন। কেয়া বললো।

ওহ, আচ্ছা। আমি যতোটা সম্ভব নিরুত্তাপ গলায় বললাম যেনো প্যারিসের তুষার বা ঝড়, কোনোটাই আমার কোনো রকম আগ্রহ নেই।

আরো একটা কথা অবশ্য ছিলো। কৌতুহল বাড়িয়ে দিয়ে বললো কেয়া।

বলতে পারো চাইলে। কৌতুহল আড়াল করে আমি উত্তর দিলাম।

ভেবেছিলাম আরো পরে বলবো। কিন্তু তুমি চাইলে এখনই বলে দিচ্ছি। কেয়া বললো। ইচ্ছে হচ্ছিলো বলি- প্লিজ তাড়াতাড়ি বলো। কিন্তু কলেজের প্রেমিকদের মতো করে গলে পড়তে মন চাইছে না। আমি চুপ করে রইলাম।

কেয়া বলতে শুরু করলো-

সামনের শীতে ঢাকা আসবো। আমার হাজব্যান্ড বড় একটা পার্টি দিবে ওর বন্ধুদের নিয়ে। আমাকে বলছে আমার বন্ধুদেরও দাওয়াত করতে। তুমি কি আসবে?

অন্ধকার যদি এমনি এমনি নেমে আসে, তাহলে ভালো লাগে। কিন্তু অন্ধকার টেনে আনলে আর তা সহ্য হয় না। কেয়ার কথার কী উত্তর দিবো ভাবতে গিয়ে মাথায় এলো এই ভাবনা।

ওপাশ থেকে কেয়া দুই তিনবার হ্যালো বললো। কিন্তু আমার উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না। আমি শুধু ফোনটা কানে ধরে রাখলাম।

Comments