অন্ধকারের গল্প


আমার দুইটা ইচ্ছা আছে। তুমি কি জানো সেগুলো কী? 

কেয়া আমাকে বললো। সে যখন কোনো কিছু খুব সহজ করে বলে, তখনই আমার বুঝতে কষ্ট হয়। কারণ তার সহজ কথাও অনেক পেঁচানো থাকে। সুতরাং এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বা সম্ভাব্য একটা উত্তর আন্দাজ করা আমার পক্ষে শুধু কষ্টসাধ্যই নয়; অসম্ভবও। 


কিন্তু আমি যদি বলি- জানি না; তাহলে পরিণাম খুব একটা ভালো হবে না। কারণ তার সাথে আমার দেখা হলো লম্বা সময় পর। এই সময়টা আমি কোনোভাবেই নষ্ট করতে পারি না।


আমি তাই মুখটা যতোটা সম্ভব হাসি হাসি করে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করলাম।


জানি তো! তোমার প্রথম ইচ্ছা হলো তোমার আইরিশ হবু স্বামীর সাথে আয়ারল্যান্ড গিয়ে স্থায়ী হবা এবং সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকবা। আর দ্বিতীয় ইচ্ছা হলো, সেই সুখের সময়টা যেভাবেই হোক তুমি কিছুটা অসুখী করে তুলবা এবং আবার দেশে ফিরে এসে এই শীতের সন্ধ্যায় আমাকে অফিস থেকে ডেকে এনে ধানমন্ডির দিকে রিকশায় করে ঘুরবা। 


উত্তরটা আমি দিলাম মজা করে। মনে হচ্ছিলো কেয়া মজাটা বুঝতে পারবে। কিন্তু সে পারলো না কিংবা পারলেও আমাকে বুঝতে দিলো না। 


মুহূর্ত কয়েকের মধ্যেই একটা দারুণ উষ্ণ কথোপকথন শীতল হয়ে গেলো। 


আমি কেয়ার মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছি। আমাদের পারস্পরিক রীতি অনুসারে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার তার পাশের চেয়ারে গিয়ে বসার কথা। কিন্তু সেই রীতি আজ নিয়ম ভাঙবে বলেই মনে হচ্ছে। 


আমরা যেই রেস্টুরেন্টে বসেছি তা বুড়িগঙ্গার একদম তীর ঘেসে তৈরি করা এক বহুতল ভবনের দ্বিতীয় তলায়। আমার পেছনের দেয়ালে একটা নরম আলোর রঙিন বাতি ঝোলানো। সেই বাতির আলো সরাসরি কেয়ার মুখে পড়ার কথা। কিন্তু তার আগে আলোটা পড়ছে আমার ঘাড়ে এসে। আর কেয়ার মুখে পড়েছে আমার ছায়া। 


এই রকম আলো-আঁধারের খেলার মধ্যে কেয়ার মুখে হঠাৎ বিষাদ নামিয়ে দিয়েছি আমি। নিজেকে অপরাধী লাগছে। অথচ অনেক দিন পরের এই সাক্ষাৎকে আমি নষ্ট করতে চাইনি। 


তুমি আইরিশের কথা তুললা ক্যান? আমি বলেছিলাম না এ বিষয়ে কিছু বলবা না? আমি ভাবছিলাম আজকের সন্ধ্যাটা অন্তত একটু শান্তিতে কাটাবো, কিন্তু তুমি যে আমাকে জীবনেও শান্তি দিবা না; সেটা আমি গাধার মতো ভুলে যাই। আমি চলে যাবো। 


না, কেয়া মোটেই গাধার মতো মেয়ে না। গাধার মতো মেয়েরা ভালোবাসা লুকাতে পারে না। কেয়া পারে। পারে মানে অত্যন্ত সুদক্ষতার সাথে পারে। এই যে আমি সাত বছর ধরে তাকে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরি, নদীর পাড়ে, রেস্টুরেন্টে, রিকশায় বসে বসে আড্ডা দেই, কিন্তু কোনোদিন নিশ্চিত করে বুঝতে পারলাম না সে আমাকে তার জীবনের সাথে জড়াতে চায় কি না। একটা অদ্ভুত, একটা অসংজ্ঞায়িত এবং অবশ্যই একটা এলোমেলো সম্পর্ককে আমরা বছরের পর বছর ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি-- সঙ্গত কারণেই তা আমরা জানি না। 


কেয়ার রাগ সম্পর্কে আমার ধারণা অত্যন্ত সামান্য। আমি যেহেতু তার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রেমিক নই, সেহেতু তার রাগ সম্পর্কে কম ধারণা থাকা আমাকে কখনো অপরাধী করে না। আবার কেবল মাত্র স্বীকৃতির অভাবে আমার মধ্যে কখনোই এতোটা আত্মবিশ্বাস জন্মে না, যার উপর ভর করে আমি বলতে পারি যে-- কেয়াকে আমার খুব চেনা আছে। 


চলে যাবো বলার পরও কেয়া চলে যাচ্ছে না। লেমোনেডের স্ট্রটা সে গ্লাস থেকে বের করে হাতে ধরে রেখেছে। কোনোদিকে ছুড়ে মারবে কি না জানি না। সেই এই মুহূর্তে কী কী করতে পারে, সে বিষয়ে আমার খুব সামান্য ধারণা আছে। আমি শুধু জানি রাগ উঠলে সে চুপ করে থাকে। 


আমি বলছি চলে যাবো। তুমি চাইলে আমার সাথে বের হতে পারো। না হলে আমি তোমাকে রেখেই চলে যাবো। 


কেয়া সম্ভবত এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে যে রেস্টুরেন্টে কাউকে একা ফেলে চলে যাওয়া একটা বিরাট শাস্তি, এবং সে সামান্য কঠিনভাবে মজা করার অপরাধে এই শাস্তিটা আমাকে দিবেই। 


রাগ করো না প্লিজ। আমি মজা করে বলছি। আর আইরিশের কথা তো আমি জানতামই না। তুমিই তো বলছিলা। 


আমার এই সহজ ও বোকা চেষ্টায় কোনো মেয়ের রাগ ভাঙার কথা না। কিন্তু কেয়ার ভাঙলো। খুব বিস্ময়কর ঠেকলো ব্যাপারটা। আমার যদিও প্রেমিকাদের রাগ ও রাগের ধরন সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। তারপরও এতো দ্রুত ও সহজে রাগ ভাঙতে দেখলে মনে হয় যে কেউ-ই অবাক হবে, আমিও হলাম। 


আচ্ছা, তাহলে ঠিক করে বলো আমার ইচ্ছা দুইটা কী? 


মনে হলো ডিআরএসে নতুন জীবন পেলাম। কিন্তু এবার আমাকে অতি সতর্কতার সাথে খেলতে হবে। আর অতি সতর্কতা যে বিপদ ডেকে আনে, সেটা কে না জানে!


একটু ইঙ্গিত দাও। আমি ঠিকই তোমার ইচ্ছার কথা বলে দিবো। 


আমার কথায় কেয়া খুব একটা আশ্বস্ত হলো না। আমি আবার জোর দিয়ে একই কথা বললাম। কিন্তু কেয়াকে মোটেও প্রণোদিত মনে হলো না। 


নাহ, তুমি বলতে পারবা না। আমিই বলছি। 


আমি চোখে-মুখে একটা আগ্রহী ও কৌতুহলী ভাব ফুটিয়ে তুলে কেয়ার চোখের দিকে তাকালাম। এক চুমুক লেমোনেড গিলে কেয়া বলতে শুরু করলো। 


আমার প্রথম ইচ্ছা হলো— যখন তুমি আমার সাথে থাকো না, তখন তুমি কিভাবে কথা বলো, কিভাবে খাও, কিভাবে ফোনে কথা বলো; আমার এগুলো দেখতে ইচ্ছে করে…


আমি স্বভাববিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় সজোরে হেসে উঠলাম। 


এইটা কারো ইচ্ছে হতে পারে? তুমি তো সামনেই দেখছো আমি কিভাবে কথা বলি, খাই… 


আমার কথা শেষ করতে দিলো না কেয়া। 


না, এভাবে সরাসরি না। আমার দূর থেকে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে।


আচ্ছা। একদিন ব্যবস্থা করবো তাহলে। তুমি পেছনে পেছনে হাঁটবা। আর আমি সামনে সামনে যাবো এবং লোকজনের সাথে কথা বলবো, টঙ দোকানে দাঁড়িয়ে একটা কলা ও বাটারবন খাবো, এক কাপ চা খাবো, কোনো বন্ধুকে একটা ফোন দিবো; ব্যস, তাহলেই তো তোমার প্রথম ইচ্ছাটা পূরণ হয়ে যাবে। 


কেয়া হেসে ফেললো। আজ সন্ধ্যায় এই রকম মন খুলে ও এই প্রথম হাসলো। 


নাহ, এভাবে হয় নাকি! তুমি যদি জানোই যে আমি তোমাকে দেখছি, তাহলে তো আর হলো না। তোমার অজান্তে দূর থেকে তোমাকে দেখতে চাই। 


কেয়ার প্রথম ইচ্ছাটা নিয়ে আরো নানা রকম কথা হলো আমাদের। শেষ পর্যন্ত কেয়া বললো— ও কোনো একদিন ঠিকই আমাকে না জানিয়ে দূর থেকে আমাকে দেখবে। আমি যেনো ওর প্রথম ইচ্ছাটা পূরণ করা না করা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা না করি, এই নির্দেশনাও এলো। কেয়া আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললো, প্রথম ইচ্ছাটা ও নিজেই পূরণ করবে। 


আর আমার দ্বিতীয় ইচ্ছা হলো, তুমি যখন আমার সাথে থাকো তখন আমার সাথে কথা বলার সময় তোমাকে দূর থেকে কেমন দেখা যায়, এটা দেখা। 


এবার আর হাসি এলো না আমার। চোখ-মুখ কুচকে আমি কেয়ার চোখে চোখ রেখে বললাম- কী বলছো! এটা আবার কেমন ইচ্ছা!


না, সত্যিই আমার এটা ইচ্ছা করে; আমার সাথে কথা বলার সময় তোমাকে আসলে কেমন দেখা যায় সেটা আমার দেখতে ইচ্ছা করে। 


আমি এই মেয়েকে কী বলবো বুঝতে পারছি না!


তাহলে তোমার কোনো বান্ধবীকে নিয়ে আসো কাল। আমরা কথা বলবো, খাবো। আর সে ভিডিও করবে। তুমি সেই ভিডিও দেখলেই তো বুঝতে পারবা আমাকে কেমন দেখায়!


ধুর, এটা হয় নাকি! তুমি যদি জানোই ভিডিও করা হচ্ছে, তাহলে কি তুমি স্বাভাবিকভাবে কথা বলবা? 


তা ঠিক!


কথা বলতে বলতে এক সময় আমি সত্যিই চেয়ারটা পাল্টালাম। আরো একটা সন্ধ্যায় আমি আর কেয়া পাশাপাশি বসে কথা বলছি। সাত বছরে এই রকম সন্ধ্যা সব মিলিয়ে কতোটা হবে— না, এখন আর হিসেব করা যাবে না। 


কিন্তু এভাবে আর কতো? 


আমার হঠাৎ প্রশ্নে কেয়া কি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো? নাহ, ওকে কখনোই কোনোভাবেই অপ্রস্তুত লাগে না। আমি যখন এ বছরের শুরুতে চাকরি-টাকরি হারিয়ে প্রায় পথে বসলাম, কেয়া শুনে বললো, ও আচ্ছা। 


কিন্তু কেয়া কি এখন অপ্রস্তুত হয়ে গেলো? 


আর কতো মানে? তুমি আর কী চাও? কী হতে হবে? 


টানা তিনটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো কেয়া। আসলেই তো— আর কতো মানে কী, কিংবা আমি কী চাই বা আমাদের জীবনে আসলে কী হতে হবে…


না, দেওয়ার মতো তেমন কোনো উত্তর আমার কাছে নেই।  


আরো কিছুক্ষণ আমরা আরো কী কী বিষয় নিয়ে যেনো কথা বললাম, এবং এক সময় আমরা রেস্টুরেন্টের আলো-অন্ধকার থেকে বেরিয়ে শুধুই একটা অন্ধকার রাস্তায় এসে নামলাম। এই রাস্তাটা কোথায় শেষ হয়েছে, তা আমরা জানি না।


শুধু জানি যে, কিছু অন্ধকার কখনো কেটে যায় না। 

Comments