তোমার কথাই ঠিক


তাহলে তোমার কথাই ঠিক। আমার অনেক আগেই চলে যাওয়া উচিত ছিলো। 

অনেক দিন পর দেখা হলো বলে একটু কি আবেগি হয়ে ছিলাম! জানি না। জানলেও ভুলে গেছি। কারণ অনেক্ষণ চেষ্টা করেও তার মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারছি না। এতক্ষণ সে যা করেছে, তা হলো— বার কয়েক দৃষ্টি বিনিময়, তাও কোনোবার তিন সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী নয়। 

সে কোনো উত্তর দিলো না। 

আমি আবার বললাম, সেই কবে তুমি বলেছিলে আমাদের হয় না। তুমি রোদ ভালোবাসো খুব। আর আমি বৃষ্টির প্রায় উপাসনা করি। তুমি মেঘ ভালোবাসো খুব। আর আমার মেঘ একদম সহ্য হয় না। তুমি সমুদ্র বলতে পাগল। আর আমি যেনো পাহাড়ের পাখি। আমাদের একদম হয় না। তুমি আসলে ঠিকই বলেছিলে। 

সে তবুও চুপ। তার মুখে একটিও কথা নেই। দৃষ্টি বিনিময়ের দয়াটুকুও সে দেখাচ্ছে না। আমি কি আবার কিছু বলবো? সে কি কোনো ধ্যানে বসলো? আমি আবার কিছু বলতে গেলে তো তার ধ্যানভঙ্গ হবে। আমি হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলাম। 

সে আমাকে আরো বলেছিলো, সে যদি হয় উত্তর মেরু, আমার অবস্থান তবে সর্বদক্ষিণে। আমাদের তাই হয় না। সে বলেছিলো, সে যদি হয় অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের নেরেতভা, আমি তাহলে ইরানের দাশত-ই লুত। তার শীতলতায় যদি রক্ত থেমে যায়, আমার উষ্ণতায় তাহলে গলে যেতে পারে সহস্র লৌহ খনি। আমাদের তাই হয় না। কিছুতেই হয় না। 

সে এখনো চুপ। যথারীতি নির্দিষ্ট কোনো কিছুতে দৃষ্টি আটকে আছে। আমরা বসে আছি এক কফিশপে। আমাদের দুটি টেবিল সামনে একটা দেয়াল। এই দেয়াল ভেদ করে তার দৃষ্টি নিশ্চয় আকাশে চলে যেতে চাইছে। আমি জানি এই অতিসামান্য দেয়াল তার দৃষ্টি বরণ করার জন্য কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। 

সে কি কিছুই বলবে না? আমার কি তার ধ্যানভঙ্গ করা উচিত? এই সব প্রশ্নে যখন আমার মন ডাঙায় এনে আছড়ে ফেলা মাছের মতো ছটফট করছে, তার উচিত তখনই কিছু বলে ওঠা এবং আমার প্রাণটা এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দেওয়া। কিন্তু সে কিছু বলছেই না। 

অন্য যে কোনো নির্বোধ প্রেমিকের মতো, অন্য যে কোনো মূক ও বধির প্রেমিকের মতো, অন্য কোনো পূর্বাবর জ্ঞানবিহীন প্রেমিকের মতো আমার এটা-ওটা ইচ্ছে করছে।

আমি জানি একটা সামান্য দেয়াল তার দৃষ্টিকে ধারণ করতে পারছে না। আমার ইচ্ছে করছে এই দেয়ালের আড়াল ভেঙে তার দৃষ্টিকে আকাশে নিয়ে যাই। আমার ইচ্ছে করছে প্রকাণ্ড আকাশাটাকে টেনে এনে এখানে, এই দেয়ালে, টানিয়ে দেই; যাতে তার দৃষ্টি অন্তত কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি পায়, যাতে তার দৃষ্টি একটি মুক্ত পাখির মতো উড়তে পারে। 

সে আর চুপ করে থাকলো না। কথা বলে উঠলো!

হ্যা, আগেই চলে যাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু চলে যাওয়ার প্রশ্ন আসার আগে তো আসার প্রশ্ন আসে, তাই না? 

এইটুকু বলে সে আবার চুপ করলো। আমিও চুপই থাকলাম। মনে হলো তার কথাটা শেষ হয়নি। 

আমার অনুমান ঠিক ছিলো। সে আবার বলতে শুরু করলো।

চলে যাওয়ার আগে আসার প্রশ্ন আসে। আমার তো মনে হয় না তুমি এতোটুকু এসেছিলে, যতোটুকু আসলে চলে যাওয়ার ব্যাপার আসে। 

আমি চুপ করে ছিলাম এবং চুপই থাকতে ইচ্ছে করলো। যখন কিছু বলার থাকে না, তখন কেবল একটাই কাজ থাকে করার মতো— তা হলো চুপ থাকা।

মিরপুর, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

Comments