নিজের জন্য লেখা


সাধারণত সন্ধ্যায় এমন হয়— আমার কিছুতেই ঘরে মন বসে না। কিছুতেই না। আমি তাই “সন্ধ্যা হলেই আবোল-তাবোল উড়ি, সন্ধ্যাবেলায় আমি বিষণ্ণ গাঙচিল”। কিন্তু ফাল্গুনে এসে ওই সন্ধ্যাবেলার ভূত ঘাড়ে চরে বসে দুপুরবেলায়। আজই যেমন, বাইরে কেমন মন উদাস করা বাতাস বইছে। আকাশে না-রোদ, না-মেঘের অদ্ভুত খেলা। এর মধ্যেই আমার আবোল-তাবোল উড়ার ইচ্ছে হলো। উড়ার ইচ্ছেটা দমন করি দুইভাবে। কখনো একেবারে নিরুদ্দেশ হাঁটতে থাকি। মিরপুর দুই থেকে কখনো ব্যস্ত রাস্তা ধরে এক নম্বর বা দশ নম্বরের দিকে, কখনো প্রশিকা মোড় থেকে সোজা পশ্চিম দিকে। যতক্ষণ ইচ্ছে করে হাঁটি। হাঁটতে থাকি। হঠাৎ কোনো একা এবং খদ্দেরহীন টং দোকান দেখলে দাঁড়িয়ে যাই, এক কাপ চা নিয়ে ২০ মিনিট ধরে খেতে থাকি। এইভাবে মনের ওড়াউড়ি থামে। আবার কখনো, ফোনটা বের করে তাকে ফোন করি। তার তীব্র অনিচ্ছা ও ততোধিক বিরক্তি উপেক্ষা করে নির্লজ্জের মতো মিনিট কয়েক কথা বলি, আমার মনের ওড়াউড়ি থেমে যায়। আমি মন স্থির করে কিছু একটা করতে বসি। “কাজ করতে বসি”-- এটা বললাম না, কারণ কাজ-টাজ আমাকে দিয়ে খুব একটা হচ্ছে না, হয় না। আজ ফাল্গুনের দুপুরে হঠাৎ মন কেমন করে উঠলো বলে একটু হাঁটাহাঁটি করতে ইচ্ছে করলো কিংবা তাকে একটা ফোন— এ ছাড়া মন বশীকরণের আর কোনো মন্ত্র আমি জানি না। এমনিতে দুপুর, মন কেমন করা বাতাস, রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড় এবং ফুটপাতে অনিঃশ্বেস খোড়াখুড়ি— কয়েক কদম হাঁটার পরই হাঁটার ইচ্ছেটা মরে গেলো। এখন আমার একমাত্র উপায় তাকে ফোন করা, তার কণ্ঠ শোনা। তার কণ্ঠটা এমন যে, প্রচণ্ড রাগ বা অভিমান নিয়েও যখন আমার শ্রবণেন্দ্রিয়তে তার কণ্ঠের শব্দ ঢোকে, আমি কেমন দ্রবিভূত হয়ে যাই। রাগ কেনো হয়েছিলো, অভিমান কেনো জমেছিলো— কিছুই আর মনে থাকে না। অথচ আমি তার কিছুই নই। একদমই কিছু নই। তার কণ্ঠে আমার মন ও মননে যে প্রতিক্রিয়া হয়, আমার কণ্ঠে তার তা হয় না। এক সময় আমার বিশ্বাস হতো যে তার মনেও একই ধরনের কিছু হয়, কিন্তু সেই বিশ্বাস ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছে। যা এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায়। এখানে “প্রায়” শব্দটা না লিখলেও মনে হয় হতো। হাঁটাহাঁটির ইচ্ছা দমন করার পর তাকে ফোন করার ইচ্ছেটাও দমন করতে হচ্ছে। দুই বছর আগে হলেও, কিংবা খুব সম্ভবত-- ছয় মাস আগেও এটা সম্ভব ছিলো ন। কিন্তু মানুষের জীবনের ক্রমশ পরিবর্তনশীল বাস্তবতা বড়ই কঠিন যা অনেক অসম্ভবও সম্ভবপর করে তোলে, আবার খুব সাধারণ দূরত্বও দুর্গম্য হয়ে যায়। না, তার দূরত্বের সীমা অতোটাও দূরে নয় যে ফোন করা যাবে না। ফোন আমি করতেই পারি। সে হয়তো ধরতেও পারে, কিন্তু এই কথপোকথনে প্রত্যাশিত উষ্ণতা থাকে না, প্রতিশ্রুতি কিংবা স্বপ্ন থাকে না। থাকে কেবল কিছু আদিম অনুভূতির অস্পষ্ট প্রকাশ, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের নিতে পারে না কোথাও। বরং এই সব কথোপকথন শেষে নিজেকে আবিষ্কার করি এক কানাগলিতে, যে গলি থেকে কোনোভাবে আর বের হওয়া যায় না। আজ আর তাকে ফোন করা হলো না। একটু হাঁটাহাঁটি করে মনকে যে ধোকা দিবো, সেটাও হলো না। এই দুই না-হওয়া ও অস্থির মন নিয়ে অগত্যা গুগল ডকের সাদা পৃষ্ঠা খুলে বসলাম। ইদানিং মনটা এ রকম অবরুদ্ধ হয়ে উঠলে আমি দুই চারটা লাইন লিখে ফেলি। সে সব লেখার দুই একটা এই ব্লগে এসে ফেলে যাই। হয়তো কোনোদিন কোনো অচেনা পাঠক এসে স্বগোক্তির মতো এই সব লেখা পড়বে। অবশ্য কোনো পাঠকের জন্য না, আমি এগুলো লিখি আমার জন্যই। পরে কোনোদিন পড়তে বসলে হয়তো আজকের এই ফেলে যাওয়া দিনটাকে চিহ্নিত করতে পারবো। অবশ্য আজকের অনুভূতিটা ততোদিনে আর তাজা থাকবে না। হয়তো নতুন কোনো বেদনা এসে পুরোনো বেদনাকে তুচ্ছ করে দিবে।


Comments