নিজের জন্য লেখা ২


ল্যাম্পপোস্টেরও কি প্রাণ আছে? 

সন্ধ্যার পর থেকে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে পা জোড়া যখন ধরে আসছিলো, তখন পাড়ার কাছাকাছি এসে টঙ দোকানে এসে থামলাম। চিনি ছাড়া এক কাপ দুধ চা নিয়ে দাঁড়ালাম এক ল্যাম্পপোস্টের নিচে। 


ঠিক তখন এই প্রশ্নটা মাথায় এলো— ল্যাম্পপোস্টেরও কি প্রাণ আছে?


জগদীশ চন্দ্র বসু সেই কবে প্রমাণ করে গেছেন যে উদ্ভিদের প্রাণ আছে। কিন্তু ল্যাম্পপোস্ট ঠিক সে রকম কোনো আলাদা সৃষ্টি নয়। কোথাও কোথাও মরা গাছের ল্যাম্পপোস্ট দাঁড়িয়ে আছে এই শহরে, কোথাও আবার স্টিলের তৈরি ল্যাম্পপোস্ট। উদ্ভিদের প্রাণ থাকলেও, কোনো মরা উদ্ভিদের নিশ্চয় প্রাণ নেই। থাকলে সেটাকে আর দেখতে মৃত লাগতো না, প্রাণহীন লাগতো না; লোকে তাদের মরাও বলতো না। তাতে একটা দুইটা পাতা-টাতাও গজিয়ে উঠতো। তার মানে মরা কাঠের ল্যাম্পপোস্টের প্রাণ নেই— প্রমাণিত! স্টিলের ল্যাম্পপোস্টের কি আছে?


নাহ, নেই! 


থাকলে এ রকম ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন বা মাসের পর মাস এই ল্যাম্পপোস্টগুলো একা দাঁড়িয়ে থাকতো না। কোনো সঙ্গী মেলার নিশ্চয়তা যদি না-ই মিলে, এরা শেষ পর্যন্ত ঝাঁক বেঁধে গলায় দড়ি-টরি দিয়ে এ রকম দাঁড়িয়ে থাকার অভিশাপ থেকে মুক্তি খুঁজতো। 


মন-টন খারাপ থাকলে সন্ধ্যার পর এলোমেলো হাঁটাহাঁটি করলে কি মাথা খারাপ হয়ে যায়?-- এবার আমার মাথায় আসলো এই প্রশ্ন; না হলে ল্যাম্পপোস্টের প্রাণ থাকা না-থাকা নিয়ে এ রকম বিস্তর গবেষণা কে করে!


আমি অবশ্য গবেষণা করার লোক না। সে কাজ অন্যদের, যারা অনেক জ্ঞাণী। আমি তাদের মতো জ্ঞাণী না হলেও এটা বুঝি যে, প্রাণ থাকলেই খুশি হওয়ার কিছু নেই। প্রাণ থাকা মানেই সেটাকে রক্ষা করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাওয়া। কিন্তু প্রাণ না থাকলে সে দায়িত্ব নেই। 


যেমন এই ল্যাম্পপোস্টের প্রাণ না-থাকায় ভালোই হয়েছে, দিনের পর দিন ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে আমার মতো অন্ধদের আলো দিয়ে যাচ্ছে।


বিপরীতে প্রাণ নিয়েও আমি মনে হয় না কারো কোনো কাজে লাগছি। উল্টো একেক দিন একেক রকমের ঝামেলা পাকিয়ে প্রাণটাকেই কেমন ক্লান্ত, অবসন্ন ও বিষণ্ণ করে তুলছি। 


এই যে কাকে ভালোবাসছি, সে কাকে ভালোবাসছে, আর তার ভালোবাসার মানুষ কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে; জীবনের এই নিগূঢ় রহস্যের দুর্ভেদ্য জাল শত চেষ্টায় ছিঁড়ে ফেলতে পারি না। অথচ প্রাণটা যদি না থাকতো, তাহলে এই ঝামেলায় পড়তে হতো না। 


চিনি ছাড়া দুধ চা যে খেতে অমৃতের মতো, ব্যাপারটা সে রকম না।


কিন্তু ল্যাম্পপোস্টের দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে খেয়াল করলাম স্বাদটা কেমন বদলে গেছে। কোনো দিন যদি এই রকম ল্যাম্পপোস্টের মতো নির্ভার, নিরাবেগ ও নির্মোহ হতে পারতাম, জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ঘৃণা-ভালোবাসা বা সংকোচ-সংশয় এড়িয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম, হয়তো অনেক ভালো হতো। দারুণ এই চিন্তা মাথায় আসতেই চায়ের স্বাদটাও যেনো বদলে গেলো।


ল্যাম্পপোস্টেরও কি প্রাণ আছে?


নেই তো! তারপরও ল্যাম্পপোস্টটাকেই কেনো আমি ঈর্ষা করতে শুরু করলাম?

Comments