তোমার স্মৃতির বিভ্রমে...

 

জানি এই স্বল্পকালীণ অথচ বাধ‍্য বিশ্রামের পর আবার দিতে হবে উড়াল, আরো একবার ক্লান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত। Genereated by DALL·E   

আমার যেতে হবে।


তিন শব্দের এই বাক‍্যটা বলে, প্রতি উত্তরে আমি কী বলতে পারি, তার কোনো তোয়াক্কা না করে তুমি হনহন করে হাটা দিলে পুরান ঢাকার একটা বাসের দিকে। তুমি চলে গেলে। 


আমি স্থির অসহায় দাঁড়িয়ে রইলাম। 


এমনিতে একাই ছিলাম। সে দিন আরো এমনভাবে একা লাগতে শুরু করলো— মনে হচ্ছিলো আমার হাতটা একা, আমার পা-টা একা, আমার মাথাটাও একা একা বাতাসে বাতাসে ভেসে যেতে শুরু করলো। 


মানিক মিয়া এভিনিউয়ের উপর তখন যতো মেঘ জমা হয়ে ছিলো, আমি নিশ্চিত কৌতুক ও করুণার অদ্ভুত চোখে তারা আমার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে সরে পড়েছিলো অন‍্য দিকে। সারা আকাশ ছেয়ে গিয়েছিলো আমার মনের বিষাদে।


আজ এতোদিন পর সেই বিষাদের দিনটা স্লো মোশন ছবির মতো ভেসে আসছে ধুলোজর্জর স্মৃতিপটে। স্মৃটি-টৃতির প্রতি আগের মতো টান নেই আমার। তারপরও সত‍্য হলো— নিজের প্রিয়-অপ্রিয় কোনো স্মৃতি থেকেই মানুষের মুক্তি মিলে না। 


মুক্তি ব‍্যাপারটা অবশ‍্য খুবই বিস্ময়কর। 


এতো বছর ধরে যে স্মৃতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন‍্য দিকবিদিক ঘুরে বেড়িয়েছি; সমুদ্রে ডুবতে থাকা মানুষের মতো এটা-ওটা, খরকুটা ধরে ভেসে থাকতে চেয়েছি, আজ জীবনের নানা সঙ্কটের নতুন অধ‍্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে ওই স্মৃতির কাছেই!


সে দিন ফেব্রুয়ারির না-শীত না-গরমের বিকেলে হঠাৎ করেই আমাদের দেখা হলো।


আমি রাস্তা পার হয়ে ওদিক যাচ্ছিলাম, আর তুমি রাস্তা পার হয়ে আসছিলে এদিকে। আমাদের দেখা হলো ঠিক রাস্তার মাঝখানে, যখন দুজনের গন্তব‍্য দুদিকে।


মুহূর্তটা যেনো মূর্ত করে তুলেছিলো আমাদের সারা জীবনের বৈপরিত‍্য। 


তারপর রাস্তা পার না হয়ে আমার ফিরে এসে দাড়ালাম একটা ল‍্যাম্পপোস্টের নিচে। ততক্ষণে আমাদের চোখের দেখা হয়ে গেছে। আমি প্রায় এক রকম টান মেরে তোমাকে সামনে এনে দাঁড় করালাম। 


তুমি আমার-কখনো-না-দেখা অনিচ্ছুক হাসি ঠোঁটে এনে বললে— কেমন আছো। আমি বললাম— ভালো। তুমি বললে— আমার যেতে হবে।


আমার কিছুই বলার থাকলো না। তুমি তো আসলে চলে গিয়েছিলে আগেই। সুতরাং সেই অযাচিত বিকেলে তোমার চলে যাওয়ার ইচ্ছার সামনে দাঁড়ানোর শক্তি, ইচ্ছা, উদ্দেশ‍্য কিছুই আমার ছিলো না। 


তুমি চলেই গেলে। কোথায়, কতো দূর— আমি আর কিছুই জানতে পারিনি।


আবার একটা ফেব্রুয়ারি, আবার ঢাকার বাতাসে জমাট ধুলোর আস্তরণ ভেদ করে বহু কষ্টে শ্বাসযন্ত্র সচল রাখতে রাখতে তোমার স্মৃতি যখন ফিরে আসছে, তখন আমার জীবন দুই ভাগে বিভক্ত।


শুধু আমার না, জীবন তো আসলে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে এই দেশের কোটি কোটি মানুষের।


তারপরও স্মৃতি তে এমন যে, তাকে ইচ্ছে করে মুছে ফেলা যায় না। সুতরাং স্মৃতির কাছে নত হয়ে আসে স্মৃতিতে হারিয়ে না যাওয়ার সমস্ত চেষ্টা। নিজেকে মনে হয় আসমুদ্র উড়ে বেড়ানো বেপথু পাখিটা; তোমার স্মৃতিই যার এক ও একমাত্র আশ্রয়। সুতরাং দুটি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত পাখনা নিয়ে আমি জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়ি তোমার স্মৃতির ডালে ডালে। 


জানি এই স্বল্পকালীণ অথচ বাধ‍্য বিশ্রামের পর আবার দিতে হবে উড়াল, আরো একবার ক্লান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত। 


আপাতত আমার যেতে হবে। 


Comments